শিরোনাম:
পাইকগাছা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

SW News24
শনিবার ● ১০ নভেম্বর ২০১৮
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » ১২ নভেম্বর হোক “উপকূল দিবস”
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » ১২ নভেম্বর হোক “উপকূল দিবস”
৮০২ বার পঠিত
শনিবার ● ১০ নভেম্বর ২০১৮
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

১২ নভেম্বর হোক “উপকূল দিবস”

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান

১২ নভেম্বর সেই ভয়াল দিন। ১৯৭০ এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলাসহ উপকূলীয় অঞ্চল বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। প্রাণ হারায় লাখ লাখ মানুষ। ১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’ প্রস্তারের যৌক্তিকতা; ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূলবাসীর জন্য স্মরণীয়। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইক্লোন’। সরকারি হিসাবে ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের প্রাণহাণি হয় বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে এর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ।

১২ নভেম্বর উপকূলবাসীর কান্না ঝরানো বেদনা বিধুর দিন। বাঙালী জাতি আজও সেই দিনের কথা ভুলতে পারেনি। ১২ নভেম্বর ১৯৭০ সাল উপকূলবাসীর জন্য অবিস্মরণীয় দিন। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সব চেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। যার নাম ছিল ‘সাইক্লোন ভোলা’। এই ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের বার্তা মানুষের কাছে ঠিকমত না পৌছানোর কারণে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে সরকারি হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে বলা হলেও বেসরকারী হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখের উপরে ছিল। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। একটি এলাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রাণ হারানোর ঘটনা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। ওই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্বীপচর সহ বহু এলাকার ঘর-বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। উপকূল অঞ্চলের বহু এলাকা বিরাণ জনপদে পরিণত হয়। সেই ভয়াল কালো রাতে উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আব্দুল্লাহ, সন্দ্বীপ, ঢালচর, চর জব্বার, তজুমুদ্দিন, চর কচ্ছপিয়া, চর পাতিলা, কুকরী কুমড়ী, মনপুরা, চরফ্যাশন, দৌলতখাঁন, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছাসে ভাসে। মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কোটি কোটি টাকার সম্পদ সহ বাড়িঘর, পশু-পাখি, ফসলের ক্ষেত, স্কুল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়।

প্রলয়ংকরী ‘সাইক্লোন ভোলা’- এর আগে এবং পরেও উপকূলের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির বিচারে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে ভয়ংকর বলে প্রমাণিত। জাতিসংঘ বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংগঠিত ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসাবে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউ এম ও) ২০১৭ সালের ১৮ মে বিশ্বের ৫ ধরণের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়ার ঘটনায় শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টি কে পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ঝড় হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়টির নাম ছিল ‘সাইক্লোন ভোলা’।

ইউকিপিডিয়ার সূত্র বলেছে, এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসাবেও এটিকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এটির নাম ছিল ভোলা সাইক্লোন। এটি সিম্পসন ক্সেল ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ১৯৭০ সালের ওই ঘূর্ণিঝড়টি ৮ নভেম্বর বঙ্গপোসাগরে সৃষ্টি হয়। ক্রমশ্র শক্তিশালী হতে হতে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৮৫ কিলোমিটারে পৌছায় ও রাতেই উপকূলে আঘাতহানে ১২ নভেম্বর কার্তিক মাসের ২৮ তারিখ। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বলা হলেও বেসরকারি হিসাব মতে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ লোক।

এত বছর পরেও স্বল্প পরিসরে হলেও ওই দিবসটি পালিত হয়। দিনটিকে স্মরণ করে গণমাধ্যমসমূহ। এবার দ্বিতীয় বারের মত উপকূল দিবস পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ’৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে। ১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোটবড় ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তবে ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা অন্যকোন ঝড় অতিক্রম করতে পারেনি।

উপকূল শব্দটির কথা ভাবলে কল্পনায় ভেসে ওঠে এক বিধ্বস্ত-বিপন্ন জনপদের প্রতিছবি। যেখানে মানুষের সিমাহীন কষ্ট। বার বার হানাদেয় ঝড়-ঝাঞ্ঝা। জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে উপকল অঞ্চল। প্রতিবছর উপকূলে দুর্যোগ আঘাত হানছে। কখনো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, কখনো জলোচ্ছ্বাস আবার কখনো তীব্র নদী ভঙ্গনে উপকূল হয় বিপন্ন। এর সঙ্গে লবণাক্ততা আর সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বদলে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এর বিরুপ প্রভাবে পড়ে জনজীবনে। প্রতিবছর বহু মানুষ বাড়ী ঘর বদল করে। এভাবে বাপদাদার ভিটেমাটি সহ বিপুল সম্পদ হারানো মানুষ আশ্রায় খোজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতি দুযোগ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করে উপকূলবাসীকে টিকে থাকতে হয়। প্রকিবছর এতো ক্ষতি সত্তেও উপকূলের ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ খুবই কম। দেশের আর্থসামাজিক কর্মকান্ডে সাগর, নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর সুন্দরবন সহ বঙ্গপোসাগর উপকূল এলাকার নদী সমূহ থেকে কয়েক কোটি টাকার মৎস্য আহরণ হচ্ছে। দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে ভিন্নমাত্রা। বাস্তবতার নিরিখে “উপকূল বাঁচলে দেশ বাঁচবে”। কেবল মাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে উপকূল অঞ্চলের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আনা সম্ভব। এরজন্য চাই উপকূল দিবস। এ কর্মসূচি সবার মাঝে পরিবেশ ও উপকূল সুরক্ষায় তথ্য ছড়িয়ে দেবে। উপকূল সুরক্ষায় আগামী প্রজন্মকে চারপাশের পরিবেশ সংরক্ষন কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে। এই প্রজন্ম যতবেশি সচেতন হবে, ঠিক ততবেশি সুরক্ষিত হবে উপকূল।

প্রতিনিয়ত বহুমূখী প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে এই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। সংকট ও সমস্যা যেমন এই এলাকায় রয়েছে, তেমনি অবারিত সম্ভাবনাও রয়েছে গোটা উপকূল জুড়ে। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গপোসাগরে চট্টগ্রাম থেকে ভোলা হয়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বৈরিতায় বসবাস করছে।

শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূল সুরক্ষায় “বিশ্ব উপকূল দিবস” সময়ের যুক্তিসংগতদাবী। ১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস। ‘উপকূল দিবস’ পালনের মধ্যদিয়ে উপকূল সুরক্ষায় আগামী প্রজন্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষকে অধিকতর সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে। উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন সহ উপকূল সুরক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে দেশে দ্বিতীয় বারেরমত তালিকা হচ্ছে উপকূল দিবস। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এই দিনটি হোক ওয়াল্ড কোস্টাল ডে।

 

লেখক ঃ সাংবাদিক

 





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)