শিরোনাম:
পাইকগাছা, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

SW News24
মঙ্গলবার ● ৩ নভেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » ফিচার » সাংবাদিকতায় কাজী ইমদাদুল হক
প্রথম পাতা » ফিচার » সাংবাদিকতায় কাজী ইমদাদুল হক
১৭৭২ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ৩ নভেম্বর ২০২০
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

সাংবাদিকতায় কাজী ইমদাদুল হক

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান………….

কালজয়ী কথাশিল্পী কাজী ইমদাদুল হক লেখক হিসাবে যশস্বী হয়েছিলেন। তিনি বৃটিশ  ভারতের একজন বাঙ্গালী লেখক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। তবে এ বিষয়টি কিছুটা কম আলোচিত । যুক্ত ছিলেন সাময়িকী সম্পাদনায় ও প্রকাশনায়। মুসলমানদের মধ্যে তিনি প্রথম শিক্ষক ও শিক্ষাবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের গৌরব অর্জন করেন। শিক্ষক পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের  সাথে জড়িত ছিলেন।  তিনি জানতেন যে, সমাজ ও সাহিত্যের সেবায় সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষক সাময়িকীর মধ্যে শিক্ষাবিষয়ক রচনার পাশাপাশি কিছু কিছু সংবাদও প্রকাশিত হতো। এর ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। মুদ্রণ মাধ্যম বলতে আমরা সংবাদপত্র, বই-পুস্তক, লিফলেট প্রভৃতিকেই বুঝি। তবে সংবাদপত্রের সঙ্গে সমাজের যোগ খুবই নিবিড়। সংবাদপত্রের দর্পণেই প্রতিফলিত হয় সমাজচিত্র। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশের সমাজ-ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে গেলে ওই সময়ের সংবাদপত্রই আমাদের তুলে নিতে হয়।

১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে কাজী ইমদাদুল হকের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে   প্রথম প্রকাশিত হয় মাসিক শিক্ষক পত্রিকাটি। মাসিক এই পত্রিকা চলেছে তিন বছর। সম্পাদক হিসেবে তিনি তাতে তার নিজের যেসব রচনা পত্রস্থ করেন তাতে রয়েছে শিক্ষা বিকিরণ বিষয়ে তার ঔৎসুক্য ও উদ্ভাবনার সুনিপুণ পরিচয়। ইংরেজি জার্নাল শব্দের মানে কোনো কিছু প্রকাশ করা। এর অর্থ দিনপঞ্জি। আর ইজম অর্থ অনুশীলন বা চর্চা। এ অর্থে জার্নালিজম বা সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় দিনপঞ্জি অনুশীলন। সেক্ষেত্রে কাজী ইমদাদুল হককে হতে হয় স্বাধীন এবং স্বাধীনচেতা। সেই গুণটি তাঁর ছিল। নিরপেক্ষতা সাংবাদিকতার আদর্শ। তিনি সেই গুণটিও রপ্ত করে নিতে পেরেছিলেন। সমাজই সংবাদক্ষেত্রকে সমর্থন জুগিয়ে থাকে। সেজন্য সমাজের প্রতি সংবাদপত্রের দায়িত্ব রয়েছে। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে কাজী ইমদাদুল হক সমাজের প্রতি তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন। কাজী ইমদাদুল হক পেশায় ছিলেন শিক্ষক। নেশায় ছিলেন লেখক। নেশা আর পেশা দুটিকেই এক বিন্দুতে মিলিয়ে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা। সে কারণে তাঁর সাংবাদিকতা বুঝতে হলে শিক্ষা দর্শনকেও বুঝতে হবে।

‘শিক্ষক’ এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৪০। দাম তিন টাকা। পত্রিকার ১ম বর্ষ ১২টি সংখ্যার (বৈশাখ- চৈত্র ১৩২৭) প্রকাশক ছিলেন কলকাতা স্টুডেন্টস লাইব্রেরির ব্রজেন্দ্রমোহন দত্ত। তিনি ওই পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।

কর্মজীবনে তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না। শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কলেজের অধ্যাপক, স্কুল পরিদর্শক, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে সে সময়কার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাবোধের আলোকে এবং নবীন প্রজন্মের প্রতি মমত্ব বোধের প্রভাবে তিনি শিক্ষাদান কার্যক্রমে বেশ কিছু অসঙ্গতি ও ত্রুটি লক্ষ্য করেছিলেন।সে সময় র্পূববঙ্গ ও আসামের শিক্ষা বিভাগ ভ’গোল শিক্ষার এক নুতন প্রণালী প্রর্বতন করেন।উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ের ভুগোলের শিক্ষকদের সেই প্রণালীর সঙ্গে পরিচয় করে দিতে তিনি বড় অসহায় হয়ে পড়েন।তিনি অচিরেই তাদের সমীপে ভ’গোল শিক্ষার নতুন প্রণালী উপস্থাপন করেন।তিনি ভুগোল বিষয়ে নানা গ্রন্থ অধ্যায়ন করে এই বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হয়েছিলেন।তারই ফলশ্রুতি তার দুই খন্ড ভুগল শিক্ষা প্রণালী। ১৯১৯ সালে ঢাকায় বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন স্থাপিত হলে কাজী ইমদাদুল হক-এর প্রথম সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।

সে আমলে সংবাদপত্র তো বটেই, মুসলমান সমাজে ভালো সাহিত্য পত্রিকারও অভাব ছিল। কাজী ইমদাদুল হক তাঁর শিক্ষা দর্শন, সমাজচিন্তা এবং সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অনেকদিন ধরেই একটা সাময়িকী প্রকাশের কথা ভাবছিলেন। তিনি জানতেন গণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ও শিল্প সাহিত্যের গুরুত্ব অনেক। সে কারণে কয়েকজন তরুণ যখন ১৩১০ বাংলার বৈশাখ মাসে ‘নবনূর’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন, তখন কাজী ইমদাদুল হক তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন। এর প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ আসাদ।

তিনি পত্রিকাটির প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে পত্রিকা প্রকাশে উৎসাহদাতা হিসেবে কাজী ইমদাদুল হকের নাম উল্লেখ করেন। নবনূরের সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ এমদাদ আলী। তিনি কাজী ইমদাদুল হক ও নবনূর প্রসঙ্গে বলেন, ‘নবনূর চারি বৎসর চলিয়াছিল। এই চারি বৎসর কাজী সাহেব নবনূরকে যে সাহায্য করিয়াছিলেন তাহার পরিমাণ করা যায় না। কেবল প্রবন্ধ দিয়া নহে, নবনূর যাহাতে বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির মাসিকপত্রে পরিণত হইতে পারে, সব সম্ভাবিত উপায়ে তিনি তাহার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। নবনূর-এর নিয়মিত প্রচারের মূলে তাহার ব্যক্তিগত প্রভাব কম কাজ করে নাই।’নবনূর- প্রকাশে কাজী ইমদাদুল হকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দু-রকম অবদানই ছিল। মূলত এমদাদ আলী ‘নবনূর’ পত্রিকার সম্পাদক হলেও বেঙ্গল লাইব্রেরির তালিকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বর্ষ ৮ম, ৯ম ও ১০ম সংখ্যার সম্পাদক হিসেবে ইমদাদুল হকের নাম রয়েছে। ‘নবনূর’ পত্রিকার প্রথম ৩৩টি সংখ্যায় কাজী ইমদাদুল হকের ২৫টি রচনা প্রকাশিত হয়।

১৯১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সমিতির মুখপাত্র হিসাবে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা নামে একটি একটি ত্রৈমাসিক পত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ছয় সদস্যের পত্রিকা পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়।  সভাপতি কাজী ইমদাদুল হক,সম্পাদক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহম্মদ মোজাম্মেল সম্পাদক , মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দিন আহম্মদ ,মইনউদ্দীন ও মোজাফ্ফর আহম্মেদ। এই সমিতির উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিলেন কাজী ইমদাদুল হক। সমিতির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ । সেখানে কাজী ইমদাদুল হকের চারটি রচনা প্রকাশিত হয়    ।

মূলত, শিক্ষকরাই পত্রিকার লেখক হলেও সে সময়ের অনেক বিখ্যাত লেখকের রচনায় ‘শিক্ষক’ পত্রিকা সমৃদ্ধ ছিল। প্রথম খ-ের লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন -কুমুদরঞ্জন মল্লিক (আবৃত্তি ও তন্ময়তা, শিক্ষকদের বেতন), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (অদল-বদল, ইতিহাস-প্রসঙ্গ), তরিকুল আলম (আমাদের শিক্ষাসমস্যা), জলধর সেন (দুকুড়ি সাত)। জলধর সেনের শিশুতোষ উপন্যাস ‘সোনার বাংলা’ মাঘ (১৩২৭) সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। এই মহৎ উদ্দেশ্যে ‘শিক্ষক’ পত্রিকায় আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষা-ব্যবস্থা বিষয়ে প্রবন্ধ, তথ্য ও সংবাদ, নতুন চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। কাজী ইমদাদুল হকের অনেক রচনা ‘শিক্ষক’ পত্রিকার প্রথম খন্ডে (১৩২৭) স্থান পায়। দ্বিতীয় বর্ষে (১৩২৮) তৃতীয় বর্ষে (১৩২৯) ‘শিক্ষক’ পত্রিকার প্রকাশক ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন নিশিকান্ত সেন। দ্বিতীয় বর্ষের ‘শিক্ষক’ পত্রিকায় কাজী ইমদাদুল হকের মাত্র দুটি রচনা প্রকাশিত হয়- ‘কল্পনা ও ভাবপ্রকাশ-শক্তির অনুশীলন’ এবং ‘শিশুদের করিবার কিছু’। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে রয়েছেন- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘ধর-পড়া, নাটিকা), দীনেশচন্দ্র সেন (বঙ্গের পুরান সাহিত্য), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (মান বড় না প্রাণ বড়, মনিবের মানরক্ষা), কুমুদরঞ্জন মল্লিক  প্রমুখ।

১৩২৯ সালে ‘শিক্ষক’ পত্রিকা তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করে। এই তৃতীয় বর্ষে কাজী ইমদাদুল হকের একটিমাত্র লেখা মুদ্রিত- কৃষি শিক্ষার নূতন প্রস্তাব। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জলধর সেন (ছেলেদের কি করি), পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় (দৈত্যের বাগান), অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ (ঋষি ও কুকুরের গল্প, শৃগাল ও ব্যাঘ্র) এবং ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাদশাদের পড়াশোনা ও বিদ্যানুরাগ)।

১৯১৯ সালে ইমদাদুল হক শিক্ষা বিভাগের কাজে গভীর দায়িত্ববোধ,অসামান্য দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তির স্বীকৃতি স্বরুপ খান সাহেব উপাধিতে ভুষিত হন। ১৯২৬ সালে খান বাহাদুর উপাধিতে সন্মানিত হন।কিন্ত সে আনন্দ না কাটতেই তা মূত্রাশয়ের পীড়া পূনর্বল দেখা দেয়।  তিনি হেকিমী মতে চিকিৎসার্থ দিল্লীর পথে যাত্রা করেন। পথে  কলকাতায় অবস্থান কালে ১৯২৬ সালের ২০ মার্চ রাতে চুয়াল্লিশ বছরেরও কম বয়সে মৃত্যু বরন করেন।

লেখক- সাংবাদিক





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)