

শুক্রবার ● ১৩ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » ফিচার » কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে বুদ্ধিমান পাখি কাক
কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে বুদ্ধিমান পাখি কাক
প্রকাশ ঘোষ বিধান
বাংলা সাহিত্যে অন্য কোন পাখির পদচারণা কাকের মত এত ব্যাপক নয়। কাকভোর, কাকচক্ষু, কাকতালীয়, কাক ভুষুণ্ডি, তীর্থের কাক, কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং ইত্যাদি বাগধারা ও উপমা বাংলা সাহিত্যে প্রচুর ব্যবহৃত হয়। কাকের মত ধূর্ত বা কাক কাকের মাংস খায় না এসব প্রবাদও ব্যবহৃত হয়েছে প্রচুর। সাহিত্যে কাক একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
কাকের ডাক অমঙ্গলের প্রতীক- এটা কুসংস্কার। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কয়েকটি দেশে কাককে অভিশাপের চিহ্ন বলে ধরা হয়। সেখানে কাক অন্ধকার আর অশুভের প্রতীক। ফসলে পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাঠে কাকতাড়ুয়া দাঁড়া করানো থাকে। অনেকক্ষেত্রে কাকেদের ভয় দেখানোর জন্য একটা কাক মেরে উঁচু জায়গায় ঝুলিয়ে রাখা হয়।
কাক পৃথিবীর সর্বত্র দেখা যায়। কাক খুবই ধূর্ত প্রাণী। কাক কর্ভিডি গোত্রের অন্তর্গত একজাতীয় কালো পাখি। কাকের উদ্ভব ঘটেছে মধ্য এশিয়ায়। সেখান থেকে এটি উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকা ব্যতীত উষ্ণমণ্ডলীয় সব মহাদেশ এবং বেশ কিছু দ্বীপ অঞ্চলে কাকের বিস্তার রয়েছে। পৃথিবীতে ৪০টিরও বেশি প্রজাতির কাক দেখা যায়। বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, হংকং, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আফগানিস্তান, কাতারসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাক রয়েছে। তবে আমাদের বাংলাদেশে সাধারণত দাঁড়কাক ও পাতিকাক এই দুই প্রকারের কাক বেশি দেখা যায়।
দাঁড়কাক ঘোর কৃষ্ণ বর্ণে আচ্ছাদিত কাক। এরা আকারে বেশ বড় হয়। এদের ঠোঁট মোটা। পাতিকাকের মাথার পেছন থেকে গলা ও বুক এবং পেটের সামনের দিকটা ধূসর বা ফ্যাকাসে ধূসর; বাকি সারা দেহ, ঠোঁট, চোখ ও পা কালো। মাথার তালু, কপাল ও গলার নিচের দিকটাও কালো। ঠোঁট দাঁড়কাকের মতো, তবে একটু কম বাঁকা। ঠোঁটে গোঁফ দেখা যায়। এরা আকারে দাঁড়কাকের তুলনায় বেশ ছোট হয়।
কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে প্রকৃতির ঝাড়ুদার পাখি কাক। শহর ও ছোট জনপদে পাতিকাক বেশি দেখা যায়, গ্রামে কম দেখা যায়। বনে জঙ্গলে একদমই থাকে না, তবে অনেকসময় রাত কাটায়। এরা জীবনধারণের জন্য পুরোপুরি মানুষের উপর নির্ভরশীল। আমরা আশপাশে যে কাক দেখি তার প্রায় সবই পাতিকাক। পাতিকাক সর্বভুক অর্থাৎ সব খায়। এদের খাদ্যতালিকা বেশ বড়। প্রাণীর মল থেকে শুরু করে ফেলে দেওয়া খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, হাঁস-মুরগির ছানা, পোকামাকড়, ফলমূল, বড় বড় ফুলের মধু, ফসলের বীজ, পাখির ডিম, ছোট সরীসৃপ, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খায়।
স্ত্রী কাক মূলত বাসা তৈরি করে। এরা প্লাস্টিক, ফিতা, রশি, কাপড়ের টুকরা, উল, তুলা, লোহার তার, পলিথিন অর্থাৎ রাস্তায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত প্রায় সব কিছু দিয়েই অগোছালোভাবে বাসা করে। কাকের বাসার অগোছালো বৈশিষ্ট্যের জন্য কাকের বাসা বাগধারাটির উদ্ভব হয়েছে। কাক নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রায় ১৮টি জনপ্রিয় বাগধারার প্রচলন আছে।
খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গদাইপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় পাশা পাশি দুইটি শিরিস গাছে কাক বাসা তৈর ডিম পেড়েছ। পুরুষ কাক স্ত্রী কাকের সঙ্গে ডিম আগলে রাখেছে ও ডিমে তা দিচ্ছে।
কাকের প্রজনন ঋতু মূলত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত, তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর বিভিন্নতা দেখা যায়। কাক একবারে ৩-৬টি ডিম দেয়। ডিমের রং আকাশি, তার ওপর থাকে কালচে-বাদামি ফোঁটা। ডিমের মোটা অংশে বাদামি ফোঁটার ঘনত্ব বেশি। স্ত্রী কাকই মূলত ডিমে তা দেয়। পুরুষ কাকও দেয়, খুব কম সময়ের জন্য। তবে বৃষ্টি নামলে, শিলাবৃষ্টি হলে বা প্রচণ্ড রোদ পড়লে পুরুষ কাক স্ত্রী কাকের সঙ্গে ডিম আগলে রাখে। ১৬ থেকে ১৭ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বেশির ভাগ প্রজাতির কাকের আয়ুষ্কাল ১০-১৫ বছর।
কাক পরিশ্রমী ও সুযোগসন্ধানী প্রাণী। কাকের বিচরণ করে যত্রতত্র। এদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তির অভ্যাস আছে এবং অধিকাংশই বেশ পরিকল্পিত চুরির ঘটনা। এরা মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বেশ নজরে রাখে, কখন কী খাবার খাবে, কোথায় খাবার পাবে, সে তার সঙ্গীকে খাবার থেকে কতটুকু দিবে এগুলো সে আগেই পরিকল্পনা করে রাখে। শুধু তাই নয়, মানুষের সান্নিধ্য পেতে এরা বাড়ির আশেপাশে থাকে। উচ্ছিষ্ট, পচাগলা খেয়ে মানুষের যথেষ্ট উপকারও করে এই পাখি। দলের কেউ অন্যায় করলে নিজেদের ভেতর বোঝাপড়া করে। মানুষ বা অন্য কারো দ্বারা আক্রান্ত হলে দলের সবাই মিলে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানায়।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট