বৃহস্পতিবার ● ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » বিবিধ » ডুমুরিয়ায় মরা ভদ্রা নদী খনন ডুমুরিয়াবাসীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র বড় উপহার
ডুমুরিয়ায় মরা ভদ্রা নদী খনন ডুমুরিয়াবাসীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র বড় উপহার
অরুন দেবনাথ।
ডুমুরিয়ায় ’৭১ যে নদী দিয়ে বড় বড় গানবোট-লঞ্চ-স্টিমার চড়ে খানসেনারা ডুমুরিয়া-শোভনা অঞ্চলে এসে মুক্তিবাহিনী ও নকশাল’দের সঙ্গে বড় যুদ্ধ করেছে, কালের বিবর্তণে আজ সেই ‘ভদ্রা নদী’র চিহ্ন মাত্রও নেই। পলি পড়ে সেইসব নদীর চর ভরাটি জমিতে আজ অসংখ্য পাকা বাড়ি-ঘর, ইট-ভাটা ধানের ক্ষেত, মাছের ঘের ও ঘেরের আইলে বাহারি সবজির ক্ষেত গড়ে উঠেছে। কিন্তু এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার মানুষের প্রযোজন অনুভব করে সেখানেই খনন করে আবারও নদী গড়ে তুলছে।
ভদ্রা ও শালতা নদী খনন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা, স্থানীয় জন প্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর থেকে খরশ্রোতা ভদ্রা নদী দিয়ে লঞ্চে করে এলাকার মানুষ খুলনায় যাতায়ত করতো। তাছাড়া বড় বড় নৌকায় করে দূর-দূরান্ত থেকে ধান-পাট আনা নেওয়া হতো। কিন্তু ১৯৯২ সালের পর থেকে এই নদীতে পলি জমতে শুরু করে। আর ’৯৮ সালের শেষ দিকে প্রায় সম্পূর্ণ নদী ভরাট হয়ে যায়। আর ২০০২’০৩ সাল থেকে ওইসব নদী ভরাটি জমিকে স্থানীয় ভূমি অফিসের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা লম্বা টাকার বিনিময়ে ভূমিহীন বা সাজানো ভূমিহীনের মাঝে দুই একর বা এক একর করে খাস জমি হিসেবে বন্দোবস্ত দিতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় সমগ্র নদীটি মানুষের দখলে চলে যায়। আর সেখানে অসংখ্য বড়-বড় দালান-সহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষত ডুমুরিয়া বাজার সংলগ্ন এলাকায় তো সেইসব জমি কিছুদিন আগেও লাখ লাখ টাকা শতক দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। কিন্তু এই নদী মরে যাওয়ায় এলাকায় জলাবদ্ধা ও পরিবেশের মারাত্মক বিরুপ প্রভাব পড়েছে। ওই অবস্থা বিবেচনা করে ডুমুরিয়া এলাকার জলাবদ্ধা নিরসন ও পরিবেশ বাঁচাতে ২০০৯ সালে তদানিন্তন সাংসদ তথা বর্তমান মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ্র এই দুটি নদী খননের জন্য সরকারের কাছে একটি ডিও লেটার দেন। তারপর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব সরদার ইলিয়াস আলী এই নদী খনন কাজটি বাস্তবায়নের জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালান। তারপর ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর একনেক সভায় ‘খুলনা জেলা জলাবদ্ধতা নিরসন কল্পে ভদ্রা ও শালতা নদী পুনঃখনন প্রকল্প’টি অনুমোদিত হয়। ৭৬ কোটি ২৫ হাজার টাকা ব্যায়ের এই প্রকল্পটি তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদীর ডুমুরিয়া বাজারের ট্রলারঘাটা থেকে গাবতলা-শোভনা-বাগমারা হয়ে তেলিগাতি পর্যন্ত ৯.৮ কিলোমিটার। দ্বিতীয় অংশে ডুমুরিয়া বাজারের ট্রলারঘাটা থেকে জয়খালি-কাজিরহুলা হয়ে বাশতলা দিঘলিয়া পর্যন্ত ১১.৭ কিলোমিটার। এবং তৃতীয় অংশে শালতা নদীর ডুমুরিয়া বাজারের ট্রলারঘাটা থেকে কাটাখালি-ভেলকামারি হয়ে টিয়াবুনিয়া পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার নদী। এই কাজে তেলিগাতি থেকে শোভনা-গাবতলা-বালিয়াখালি এলাকা পর্যন্ত ভদ্রা নদী খননে টপ ২৬০ থেকে ৩০০ ফুট, তলা ২১৩ ফুট ও গভীরতা ১৪ ফুট। তবে ডুমুরিয়া সদর এলাকায় টপ ৬০ থেকে ৭০ ফুট আর তলা ৩৩ ফুট। আর দিঘলিয়া সাহস এলাকায় টপ ৮০ থেকে ১০০ ফুট আর তলা ৬৬ ফুট খনন করা হবে। এই খনন প্রকল্পে দুই নদী’র সর্বমোট ৩০.৫ কিলোমিটার নদী খনন কাজটি ২০১৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নদী খনন শেষে ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে খনন করা নদীতে পলি পড়া বন্ধ ও জলনিষ্কাশন নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ভদ্রা নদীর তেলিগাতি ও বাশতলা-দিঘলিয়া অংশে ১০ ভেন্টের(কপাট) দু’টি স্লুইচ গেট নির্মান করা হবে। ৩০.৫ কিলোমিটার নদী খনন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভদ্রা নদীর দুই অংশের খনন কাজ ৯টি প্যাকেজে বিভক্ত করে বাস্তাবায়নের জন্য ৭ জন ঠিকাদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে নদী দু’টির চর-ভরাটি জমিতে ৫৭৩ জন পাকা-বাড়ি, কাঁচা-বাড়ি, মাছের ঘের, ধানের ক্ষেত-সহ বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছিলো। এলাকাবাসীর সহয়তায় তারা সেসব স্থাপনা ইতোমধ্যে সরিয়ে নিলেও খর্ণিয়া এলাকার ভদ্রা নদীর চরে সেতু ব্রিক্স, এজি ব্রিক্স ও সেভ ব্রিক্স এবং সাহস এলাকায় জেড.এস.বি ব্রিক্স ও জেবিÑ২ ব্রিক্স এখনও সরকারি জমির ওপর তাদের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করেনি।
এ প্রসঙ্গে শোভনা ইউপি চেয়ারম্যান সুরজ্ঞিত বৈদ্য বলেন, দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা নিরসন কল্পে আমাদের মৎস্য প্রতিমন্ত্রী’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ নদী খননের মতো এই ঐতিহাসিক কাজ হচ্ছে। এতে এলাকার অধিকাংশ জনগনের উপকার হবে বলে তারা খুব খুঁশি। খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে এই খনন কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক উপ-সহকারি প্রকৌশলী রাশিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালের জুন থেকে কাজ শুরুর কথা থাকলেও জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতার কারণে খানিকটা দেরি হয়েছে। তবে ১ ডিসেম্বর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৮টি স্কেভেটর দিয়ে খনন কাজ চলছে। তাছাড়া যথাসময়ে নদী খনন শেষ করতে এই প্রকল্পে অতিসত্ত্বর আরও ৬০টি স্কেভেটর নামানো হবে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে শালতা নদীর অংশে খননের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। তারাও দ্রুত কাজ শুরু করবে। এই বিশাল কর্মযোগ্যের প্রধান পুরুষ ডুমুরিয়া-ফুলতার সাংসদ তথা মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ বলেন, বর্তমান সরকারের প্রধান জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মরা ভদ্রা নদী খননের ব্যবস্থা নিয়ে ডুমুরিয়াবাসিকে সবচেয়ে বড় উপহার দিয়েছেন। আর এই নদী খননের ফলে এলাকার জলাবদ্ধা দূর হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের উন্নতি ঘটবে।