

বৃহস্পতিবার ● ১৫ মে ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » উপকূলবাসীর দুঃখ; নাজুক বেড়িবাঁধ
উপকূলবাসীর দুঃখ; নাজুক বেড়িবাঁধ
নড়বড়ে বেড়িবাঁধের ঝুঁকিতে উপকূলবাসীর দুঃখে গাথা জীবন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আর আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায় উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধের বেশিরভাগ অংশই ঝুঁকিতে থাকায়, গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে দুশ্চিন্তায় উপকূলবাসী। ফসলি জমি ও জানমাল রক্ষায় ষাটের দশকে নির্মিত এসব বাঁধ কখনই পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি। ফলে প্রতিবছরই ভারী বৃষ্টিতে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে ডুবে যায় উপকূলীয় এলাকা। নদ-নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চচাপের কারণে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। নড়বড়ে বেড়িবাঁধে প্রায়ই কোথাও না কোথাও ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে বিস্তির্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। পানিতে ভেসে যায় ফসলি জমি, পুকুর ও মাছের ঘের। সিডর, আইলা, আম্ফানসহ নানা দুর্যোগে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে খুলনাসহ উপকূলের বেড়িবাঁধ।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সুরক্ষা নির্বাহ করে বেড়িবাঁধের ওপরে। বাঁধ ভালো থাকলে তারা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। আর বাঁধ ভেঙে গেলে তাদের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, রাস্তাসহ সবকিছু পানিতে ভেসে যায়। নিঃস্ব হয়ে পড়ে মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সিডর, আইলা, ফনী, আম্ফান ও ইয়াসের মত ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত উপকূলবাসী। দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে বেড়িবাঁধই উপকূলের একমাত্র রক্ষাকবচ। অথচ ষাটের দশকে নির্মিত বেড়িবাঁধ জোড়াতালি দিয়ে এতদিন চলে আসলেও বর্তমান পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। শক্তিশালী বেড়িবাঁধের অভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকে সব মৌসুমেই, বর্ষায় পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করে। আগের বছর গুলোর তুলনায় সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে। মৌসুমি বর্ষায়, এমনকি জোয়ার ভাটায়ও নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে।
উপকূলীয় বাসিন্দাদের বেশিরভাগই দরিদ্র এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট বিপদ উভয়েরই সংস্পর্শে রয়েছে। দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও বরিশালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধের বেশিরভাগ অংশই ঝুঁকিতে থাকায়, গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে দুশ্চিন্তায় থাকে উপকূলবাসী। ফসলি জমি ও জানমাল রক্ষায় ষাটের দশকে নির্মিত এসব বাঁধ কখনই পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি।
সরকারের হিসাবে দেশে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় ৮ জেলাতে মোট বাঁধের আয়তন ৫ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় মোট দুই হাজার ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। খুলনা জেলায় ৯৯৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে চলে আসার পর টানা কয়েক বছর ফসল হয় না। সিডর, আইলা, আম্ফানসহ নানা দুর্যোগে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে খুলনা উপকূলের প্রায় পৌনে ৯শত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ফলে প্রতিবছরই ভারী বৃষ্টিতে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে ডুবে যায় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েকটি স্থান। বাঁধ ভাঙলে তা সংস্কার না করে শুধুমাত্র ভাঙা জায়গা মেরামত করা হয়। শুধু খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার ২১টি পয়েন্ট এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির ২৯টি পয়েন্টে নতুন ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
উপকূলীয় এলাকায় অনেক জায়গায় বাঁধের চেয়ে জোয়ারের উচ্চতা বেশি থাকায় বসতি ও কৃষিজমিতে পানি প্রবেশ করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে দেখা দিয়েছে স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দ্রুত মেরামত না হওয়া। বেশির ভাগ জায়গায় ঠিকাদারদের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে বাঁধ দুর্বল ছিল। অনেক জায়গায় ঠিকমতো মেরামত হয়নি। ফলে বাঁধ ভেঙেছে, আবারও ভাঙতে পারে। ফলে জোয়ার–ভাটার পানি বেড়িবাঁধগুলো ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবেশ করছে। এতে বাঁধের ফাটা অংশ আরও বড় হচ্ছে। সময় যত যাবে, বাঁধের ফাটল আরও বড় হলে মেরামতের খরচও বাড়বে।
দেশের বেড়িবাঁধের বর্তমান ডিজাইন ষাটের দশকের। তখনকার তুলনায় বর্তমানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আরও ক্ষীপ্রগতিতে আঘাত হানছে। প্রকৃতির গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন হলেও বেড়িবাঁধের ডিজাইন আধুনিকায়ন হয়নি। আনা হয়নি কোনো ধরনের পরিবর্তন। ফলে একটু বেশি জোয়ার হলেই বাঁধ ভেঙে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। মেরামত সংস্কারে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ কোন কাজে আসেনি বরং প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের ঘটনা ঘটেছে, হয়েছে অর্থের অপচয়। নতুন বাঁধ নির্মাণেও অর্থ লুটপাট হয় দুর্নীতির মাধ্যমে, তারপর কোনক্রমে তৈরি করে দুর্বল বাঁধ। ফলে জলোচ্ছ্বাসের সময় পানির চাপে নাজুক বাঁধ ভেঙে যায়।
সময়ের পরিক্রমায় উপকূলের সুরক্ষা বাঁধগুলো দুর্বল এবং নিচু হয়ে গেছে। ইঁদুরের গর্তেও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেড়িবাঁধের ঢালুতে ছিন্নমূল মানুষ ঘর তৈরি করে বসবাস করে। অনেকে বেড়িবাঁধের ওপর নানা ধরনের গাছ, শাকসবজি আবাদ করে। এসব দেখভালে উপজেলা পর্যায়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেখভালের জন্য নেই তেমন কোনো জনবল।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আগে বেড়িবাঁধে ৬ মাস সময় নিয়ে মাটি ভরাট করা হতো। বিশেষ করে ডিসেম্বরে মাটি ভরাট শুরু হতো, শেষ হতো জুনে। প্রায় ৬ মাস মাটি ভরাটের ফলে মাটি স্বাভাবিক নিয়মে ভালোভাবে বসে শক্ত বাঁধ তৈরি হতো। এখন বেড়িবাঁধের টেন্ডারে সর্বোচ্চ ৩ মাস বা ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়। অনেক সময় আরও কম সময়ে বর্ষার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধের কাজ করতে হয়। এতে কাজের মান বলে কিছু থাকে না। তৈরি বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। ফলে সামান্য জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে জীবন ও সম্পদহানির ঘটনা ঘটে। উপকূল এলাকা বাঁচাতে টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে উপকূলবাসীর কষ্টের শেষ নেই।