শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

SW News24
মঙ্গলবার ● ১৬ জানুয়ারী ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » স্মরণে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ ও স ম আলাউদ্দিন
প্রথম পাতা » মুক্তমত » স্মরণে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ ও স ম আলাউদ্দিন
১১৭ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ১৬ জানুয়ারী ২০২৪
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

স্মরণে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ ও স ম আলাউদ্দিন

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কপিলমুনি যুদ্ধ এক বিরল ঘটনা।কপিলমুনি দক্ষিণ খুলনা তথা পাইকগাছার একটি প্রাচীন জনপদ। কপিলমুনির রূপকার ও স্থপতি ছিলেন রায়সাহেব বিনোদবিহারী সাধু। কপিলমুনি জুড়ে তার স্মৃতি বিদ্যমান। কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। বিনোদ বিহারী সাধুর বাড়িতে তারা ঘাঁটি গেড়েছিল। এটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল।

১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও খাসসেনাদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে খুলনা শহরের খানজাহান আলী রোডের আনসার ক্যাম্পে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এর দায়িত্বে থাকে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ।দেশের অন্যান্য স্থানেও রাজাকার   বাহিনী গড়ে তোলা হয়। কপিলমুনিতে ২শত জনের বেশি রাজাকার নিয়ে তারা বিনোদবিহারী সাধুর বাড়িতে ক্যাম্প গঠন করে। কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন আফসার শিকারি নামে এক ব্যক্তি।

কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের দুর্গ এবং শক্তিশালী ঘাঁটি৷ এ ঘাঁটির মাধ্যমে কপিলমুনি, তালা, ডুমুরিয়াসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিশাল অংশ রাজাকাররা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল৷ খুলনার ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক নগরী বিনোদগঞ্জ প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারীর বাড়িটি ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি৷ ২শত এর বেশী রাজাকার ও মিলিশিয়ার ছিল সশস্ত্র অবস্থান৷ সুবিশাল দোতলা ভবন, চারদিকে উঁচু প্রাচীর অনেকটা মোগল আমলের দুর্গের মতো৷বাড়িটি ছিল রাজাকার ও আলবদরদের দুর্ভেদ্য ঘাটি। ১২ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রস্থ প্রাচীর বেষ্টিত ২টি লোহার কলাপসিবল গেট দ্বারা সুরক্ষিত। কপোতাক্ষ তীরে বহু কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল প্রাসাদ। রাজাকাররা কপিলমুনি বিনোদ বিহারী সাধুর সুরক্ষিত দ্বিতল ভবনটি নিরাপদ দুর্গ হিসাবে গড়ে তোলে। রাজাকাররা কপিলমুনি বাজার থেকে শত শত বস্তা চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ঘি তেলসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু লুট করে উক্ত বাড়ির একটি কক্ষে বোঝাই করতো। কাশিমনগর হাট ও এলাকা থেকে পছন্দের গরু ছাগল ধরে আনতো। রাজাকারদের বাদশাহী কায়দায় খানাপিনা তৈরী ও আপ্যায়নের কাজে ৪ জন বাবুর্চি ছিল।

সুরক্ষিত দুর্গে বসে চলতো তাদের অত্যাচার৷ জোর করে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি আনা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল৷ এলাকাটিতে হিন্দুদের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন, ধন-সম্পদ লুট এমনকি জোর করে তাদের অনেককেই ধমানত্মরিত করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়৷ হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে৷ লালসার শিকার হন অগণিত মা-বোন৷ তাদের নির্যাতনের মাত্রা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, আজো সে দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই গা শিঁহরে ওঠেন৷ মানুষ ধরে দেয়ালে পেরেক দিয়ে শরীর গেঁথে রাখা হতো৷ হাত-পা কেটে ছিটানো হতো লবণ৷ এমনকি বড় বড় ইট দিয়ে শরীরে আঘাত করে হত্যা করা হতো৷ নির্যাতন করে হত্যার পর গোপণ সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ পাশের কপোতাৰ নদে ফেলে দেয়া হতো৷ এই ক্যাম্পের রাজাকাররা খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেনি। তারা ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন বের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খোজে গিয়ে গ্রামের নিরীহ মানুষকে ধরে এনে অত্যাচার করত। এলাকার উঠতি বয়সের যুবতি মেয়েদের ধরে এনে ক্যাম্পে অত্যাচার করা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে পড়েছিল। রাজাকাররা হিন্দু আর বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত। রাজাকার বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনলে এলাকার নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবকরা সবাই পালিয়ে যেত।

স্বাধীনতা যুদ্ধে স ম আলাউদ্দিনের অবদান চিরস্মারণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের তৎকালীন গণপরিষদের ও প্রাদেশিক পরিষদের যে কয়েকজন সদস্য সরাসরি অস্ত্র হাতে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছিলেন তাদেরই অন্যতম স ম আলাউদ্দিন। ১৯৭০ সালে জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদের নিবাচনে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদে ১৬৭ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৯৮ জন নির্বাচিত সদস্যের প্রায় সকলেই ভারতে চলে যান। এর মধ্যে ৯ জন সদস্য অস্ত্র হাতে সরাসরির যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স ম আলাউদ্দিন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ভারতে বিহার প্রদেশে চাকুলিয়ার সিএনসি বিশেষ টিমে ৬ সপ্তাহের যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ঐ বিশেষ টিমে তিনিসহ ১৪ জন এমএনএ, এমপি এবং ৩ জন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।

খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও রবিশাল নিয়ে এফ সেক্টর গঠিত হয়। এফ সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তোফায়েল আ্হমেদ। আমির হেসেন আমুর দায়িত্ব ছিল বনগাঁয়ে থেকে বিভিন্ন এজেন্ট এর মাধ্যমে ছেলেদের বাছাই করা। আমু’র পক্ষে স ম আলাউদ্দিন ভারতের বশিরহাটে একটি হোটেলে রিক্রটিং অফিস করেন। তিনি বাগুনডিয়া ও ইটিন্ডিয়া ক্যাম্পে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োজিত হন। প্রাদেশিক সদস্য হিসেবে টাকি, তকিপুরসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ছেলেদের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি নেতৃস্থানীয় ছেলেদের তাদের নিজস্ব সীমান্তে গিয়ে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। মুজিব বাহিনীর কয়েকটি গ্রুপের ট্রেনিং শেষ হয়ে যাওয়ায় পর সাতক্ষীরা মহাকুমার বিপুল সংখ্যক গেরিলা নিয়ে তিনি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। কপিলমুনি থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে তালা থানার মাগুরা ইউনিয়নের মাদার গ্রামে ছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। কয়েকশত মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর একটি শক্তিশালী কমাণ্ড। এই গ্রামটি নিরাপদ জেনে ঘাটি স্থাপন করেছিল। কমান্ডার ছিলেন খুলনা জেলার মুজিব বাহিনী উপপ্রধান ইউনুস আলী ও তালা থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান মোড়ল আব্দুস সালাম। দুইজনই ভারতের দেরাদুন থেকে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং প্রাপ্ত। দুই কমাণ্ডারের একান্ত প্রচেষ্টায় দুই মাসের মধ্যে তালা থানার ১২টি ইউনিয়নে দুই শতাধিক গেরিলা যোদ্ধা তৈরী হয়। গেরিলাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন মুক্তিযোদ্ধা ও বৃহত্তর খুলনা জেলার মুজিব বাহিনী প্রধান  কামরুজ্জামান টুকু ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য স ম আলাউদ্দিন।

রাজাকারদের প্রধান কাজ ছিল এলাকা থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ধরে আনা ও তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো। উক্ত ক্যাম্পে নারী নির্যাতনে কয়েকজন নারীর মৃত্যু ঘটেছে। নারী নির্যাতনের পাশে একটি ছোট রুমে আওয়ামী লীগ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ধরে এনে শারীরিক অত্যাচার করে গোপন তথ্য বের করার টর্চারিং সেল ছিল। নির্যাতনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের রুমের দেয়ালের সাথে হাতে, পায়ে, মাথায় ও বুকে বড় বড় লোহার পেরেক বিদ্ধ করে নির্মমভাবে খুন করতো। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা রুস্তমের দেহ পেরেক বিদ্দ অবস্থায় দেওয়ালের গায়ে পাওয়া যায়। রাজাকারের অপারেশন ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৪শ ১৩ জন মানুষকে তারা খুন করেছিল। রাজাকারদের আগ্নোয়াস্ত্র বলতে রাইফেল ছাড়া আর ছিল না। তবে টিন দিয়ে বড় ব্যারেল তৈরী করে কালো রং করে কামান মত ডামি কামান ছাদের উপর পেতে রেখেছিল। ছাদের উ্পর বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করা ছিল। মনে হতো ছাদের উপর কামান পাতা আছে, বাইরে থেকে দেখে সবাই দারুণ ভয় পেত।

মুক্তিযোদ্ধারা সেখানকার রাজাকারদের বিরুদ্ধে আগেও দু’তিনবার লড়াই করেছে; কিন্তু তাদের হারাতে পারেনি।  মুক্তিবাহিনী ১১ জুলাই কপিলমুনিতে প্রথম আক্রমণ চালায়৷ আরেকবার তালা থানার বাম ও নকশালদের সমবেত চেষ্টায় রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়৷ কিন্তু পর পর ২টি আক্রমণ আশানুরূপ ফল না হওয়ায় রাজাকারদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায় ৷ তাই শত্রু মনে করে যে কোনো লোককে রাজাকাররা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে ক্ষমতার দাপট প্রকাশ করতো৷ এক পর্যায়ে তাদের অত্যাচারে এলাকার মানুষের প্রাণ বাচানো ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে৷

রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এলাকার মুক্তিযোদ্ধাগণ এই ক্যাম্প ধ্বংস করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কপিলমুনির এ শক্ত রাজাকার দুর্গ আক্রমণের জন্য তৈরি করা হয় মহাপরিকল্পনা৷ এবার আঁটসাঁট বেঁধেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় এলাকার বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয় করে। সংকল্প হয় ঐ ঘাঁটির পতন না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের। কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প পতনের এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মুজিব বাহিনীর খুলনার উপপ্রধান ইউনুস আলী, নৌ কমান্ডো দলের লে:রহমতউল্লাহ, স.ম বাবর আলী, লেঃ শামসুল আরেফিন, স.ম আলাউদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর রহমান প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন থানার কয়েকশ’ মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে অংশ নেন।

৭১ এর ২০ নভেম্বর কপিলমুনি যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন কমাণ্ডার ইউনুস আলী ও মোড়ল আব্দুস সালাম। এই পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করে মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান, সামছুর রহমান, জয়নুল, সুভাষ সরকার, মকবুল ইসলাম, নির্মল পাল, আবু বকর মোড়ল, শরিফুল ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধান নেতৃবর্গ ও কমাণ্ডারদের সমন্বয়ে এক জরুরী বৈঠক আহবান করা হয়। মাগুরার প্রখ্যাত জমিদার শান্তি শেখর রায় চৌধুরী ওরফে ঝুনু বাবুর দোতালায় রুদ্ধদার বৈঠক হয়। আলোচনায় কপিলমুনি যুদ্ধের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু,  স ম বাবর আ্লী, স ম আলাউদ্দিন, সুভাষ সরকার, মুজিবর রহমান, সামছুর রহমান, মাস্টার সুজাত আলী, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। উক্ত বৈঠকের আবহায়ক ছিলেন কমাণ্ডার ইউনুস আলী ইনু ও মোড়ল আব্দুস সালাম। রাজাকারদের সমঅস্ত্র ও জনবল সম্পর্কিত গোপন সংবাদ সরবরাহ দায়িত্ব প্রদান করা হয় সরদার ফারুক আহম্মদ ও চেয়ারম্যান নুর খাঁর উপর। কপিলমুনি যুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তানি নৌ-বাহিনীর লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদুকে প্রধান কমাণ্ডার নির্ধারণ করা হয়। তার নির্দেশে যুদ্ধ চলবে এবং যুদ্ধ শেষ হবে। ব্যতিক্রম হলে রেহাই পাবে না কোন মুক্তিযোদ্ধা। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুজিব ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত কমাণ্ড। সকলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কপিলমুনির রাজাকার বাহিনীকে সমূলে নিধন করে তবে ফিরবে।কপিলমুনিতে বিনোদ বিহারী সাধুর  বাড়ির মূল ভবনের দেয়াল ছিল ২০ ইঞ্চি গাঁথুনির আর সীমানা প্রাচীর ছিল ১৫ ইঞ্চির। এরপরও রাজাকাররা তাদের ঘাঁটির নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বড় বড় সুন্দরী গাছ দিয়ে একটি প্রাচীর গড়েছিল। বিল্ডিংয়ের ছাদের চারকোণে চারটি বাঙ্কার তৈরি করেছিল রাজাকাররা। উপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত গুলি চালানো যেত। সব মিলিয়ে ভবনটি এতই সুরক্ষিত ছিল যে, সেখানে আক্রমণ চালানো অত্যন্ত দুরূহ ছিল। এ কারণে এমনভাবে পরিকল্পনা সাজানো হয় যাতে রাজাকারের পরাজয় নিশ্চিত হয়।

৫ ডিসেম্বর ৯ নম্বর সাবসেক্টর কমান্ডার লে. কমান্ডার রহমতউল্লাহ্ দাদু ভাইকে প্রধান ও স. ম. বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ইউনুচ আলী,স ম আলাউদ্দিন, আবুল কালাম আজাদকে কপিলমুনির যুদ্ধে সহ নেতৃত্ব প্রদান করেন। পাইকগাছা থানার কাটিপাড়া ক্যাম্পে লে. কমান্ডার রহমতউল্লাহ্ দাদু ভাই উপস্থিত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রিফিং প্রদান করেন। অন্যদিকে তালা থানার মান্দ্রা ক্যাম্পে ইউনুচ আলী ব্রিফিং প্রদান করেন।

কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল চতুর্মুখী। কপিলমুনি যুদ্ধে পরিকল্পনানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ৬ ডিসেম্বর ১০ জন কমাণ্ডারের নেতৃত্বে ১৮টি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পথে রাত ১২টায় মাগুরা থেকে কপিলমুনিতে রওনা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাইফেল, এসএলআর মর্টার, অটোমেটিক রাইফেলসহ প্রচুর গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সিদ্ধান্ত ছিল শেষ রাতে মর্টারের গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু কমাণ্ডার স ম বাবর আলীর গ্রুপ সোনাতনকাটী খেয়া পার হয়ে নাসিরপুর ব্রীজের সন্নিকটে পৌঁছালে ১৪ জন ডিউটিরত রাজাকাররের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ মাঠের সংকেত দ্বারা অভিহিত করা হয়। কিন্তু শত্রু পক্ষের লোক বিধায় সংকেতের জবাব দিতে ব্যর্থ হলে স ম বাবর আলীর হাতে এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে ১৪ জন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এই অনাকাক্ষিত বিভ্রাটে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ অসুবিধা ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। যদিও তাতে কোন আত্মঘাতি ঘটনা ঘটেনি।

পরিকল্পনা অনুযায়ী  মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে জলে ও স্থলে পাহারায় বসানো হয়, যাতে রাজাকারদের সহায়তার জন্য কোনো পাকিস্তানি সেনা না আসতে পারে। মূল ঘাঁটির পশ্চিম দিকে বেড়িবাঁধের পাশে নৌ কমান্ডোরা অবস্থান নেয়। ঐ দিন দিবাগত রাতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। রাত ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা যার যার অবস্থানে পজিশন গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা হরিঢালী স্কুল, কপিলমুনি গার্লস স্কুল, কপিলমুনি বিদ্যামন্দির, নদীর ওপার কানাইদিয়া, গোলাবাড়ী স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে রাজাকার ক্যাম্প ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত ৪টার দিকে দাদু ভাই এসএমজি দিয়ে ফায়ার ওপেন করেন। রাজাকার ক্যাম্প লক্ষ্য করে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি শুরু করেন। রাজাকাররাও বাংকার থেকে গুলি করতে থাকে।

মুক্তিবাহিনী সম্মিলিকভাবে সাড়াশি আক্রমণ শুরু করে রাজাকারদের মূল ঘাটিতে। ডিনামাইট দিয়ে কপিলমুনি ও তালার মধ্যবর্তী কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হল। রাস্তায় মাইন বসিয়ে গেরিলারা এম্বুশ পেতে রাখে। টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়।পাকসেনারা এসে যাতে কপিলমুনির রাজাকারদের সহায়তা করতে না পারে সেজন্য কানাইদিয়া গ্রামের রাস্তার কালভার্ট উড়িয়ে দেয়ার  পরিকল্পনা করা  হয়। স.ম আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল অবস্থান নেয় রাস্তার পাশে তৈরি করা পরিখায়। তাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানী সৈন্যরা আসছে বুঝতে পারলে কালভার্ট উড়িয়ে দেয়া। এই স্থানে কার্ট অফ পার্টির কমাণ্ডার ছিলেন স ম আলাউদ্দিন। তবে পাকিস্তানী সৈন্যরা না আসায় সেটার প্রয়োজন পড়েনি।

৬ ডিসেম্বর তারিখ ভোর হয়। এই দিন ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পান। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির সংকট দেখা দিলে কমান্ডারগণ ভারত থেকে গুলি এনে সেই চাহিদা পূরণ করেন। রাজাকাররা ক্যাম্পে আটক থেকে মাঝেমধ্যে গুলি করতে থাকে। বিরামহীন যুদ্ধ চলতে থাকে। তবে আরসিএল এর শত শত গোলা নিক্ষেপ করেও উক্ত রাজাকার দুর্গের একটি ইটও খসানো যায়নি।  এমতাবস্থায়   যুদ্ধ শুরুর  পরের দিন মাইকে রাজাকারদের নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে আত্মসমার্পণ করতে বলা হয়। কিন্তু তার জবাবে তারা আত্মসমার্পণ না করে বাড়ীর ভিতর থেকে মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালিগালাজ ও আত্মসমার্পন করতে বলে। এমনকি রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রকার হুমকি প্রদানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসমার্পণ করার নির্দেশ দিতে থাকে। এ ঘোষণা শুনে মুক্তিযোদ্ধাদের মেজাজ চরমে উঠে যায়। তারা আমরণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।

একইভাবে ৭ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ক্যাম্পের মধ্যে অবস্থান করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বারবার মাইকযোগে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তারা আত্মসমর্পণ করে না। ক্যাম্পের মধ্য থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে থেমে থেমে গুলি করতে থাকে। রাজাকারদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে বাঁচার কোন পথ নেই দেখে রাজাকাররা দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে স ম আলাউদ্দীন ভারত থেকে মর্টার ও প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে আ্সছে জানতে পেরে রাজাকারদের মনোবল আরো ভেঙ্গে পড়ে।

রাজাকারদের বাইরের সহায়তা পাওয়ার সব আশা শেষ হয়ে গেলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে গেলে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। ৯ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় তারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে সব রাজাকারকে ক্যাম্প থেকে বের করে আনে। ক্যাম্পের মধ্যে চার জন বীরাঙ্গনাকে পাওয়া যায়। তাদের আটকে রেখে রাজাকাররা অমানুষিক নির্যাতন করেছে। তালার মাছিয়াড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আলী গাজীকে দেওয়ালের সঙ্গে পেরেক দিয়ে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় ক্যাম্পের মধ্যে পাওয়া যায়। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে এলাকার মানুষ ‘জয়বাংলা’ বলে একত্রিত হয়  স্কুলের মাঠে। হাজার হাজার উত্তেজিত জনতা রাজাকারদের মেরে ফেলার দাবি করে৷ যে যেভাবে পেরেছিল আক্রমণ করেছিল রাজাকারদের ওপর৷  তারা রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করতে থাকে। স্বজনহারা লোকজন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। জনগণের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাক্ষীক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ একত্রিত হয়ে রাজাকারদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এলাকার মানুষের দাবি অনুযায়ী গণ-আদালত গঠন করে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ১৫১ জন(ভিন্ন মতে ১৫৬ রাজাকার)    রাজাকারের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করেছে, তাদের আলাদা করে এবং অন্যদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধকালীন ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায়৷ বাসত্মবায়িত হয় গণআদালতের রায়৷ কপিলমুনি যুদ্ধে দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বাজারের প্রধান সড়ক পার হতে গিয়ে রাজাকারদের গুলিতে কেয়ারগাতির আনসার আলী ও খুলনার আনোয়ার শহিদ হন। আগরঘাটার মুক্তিযোদ্ধা তোরাব আলী আহত হন।

কপিলমুনি আক্রমণের পরিকল্পনা ও সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লে: গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, স ম বাবর আলী, ইউনুস আলী, স ম আলাউদ্দিন, মোড়ল আব্দুস সালাম, সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী রফিকুল ইসলাম, কামরম্নজ্জামান টুকু, রশীদ, মকবুল হোসেন, সামাদ মাস্টার, জিলস্নুর রহমান, গাজী আনছার  খালেক, মোশারফ, আবু জাফর, খোকা, জোয়াদ্দার রসুল বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর রহমান, ফারুক সরদার, তোরাব, কাইয়ুম, বিনয়, তৌফিকসহ বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা৷ তাদের অবদান চির স্মরণীয়।

কপিলমুনি  মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে। কপিলমুনি যুদ্ধ নিয়ে ইতিমধ্যে নাটক তৈরী হয়েছে। যা খুলনা বেতার থেকে কয়েকবার প্রচারিত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে কপিলমুনিতে রাজাকারদের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনী ও মুজীব বাহিনীর সম্মিলিত কমাণ্ডের সাথে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর মধ্যে এই যুদ্ধ একধারে চলে ৭২ ঘন্টা। অবশেষে ৯ ডিসেম্বর পরাজয় বরণ করে ১৫১ জন রাজাকার ও আলবদর। ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি পাক হায়েনা ও তাদের দোসরদের কবল থেকে মুক্ত হয়৷ বাংলাদেশের অভু্যদয়ে তথা ৭১ সালে কপিলমুনি যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য৷

মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরসেনানী ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম আলাউদ্দিন ইতিহাসের উজ্বল নক্ষত্র। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তালা-কলোরোয়া আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদ লাভ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তালা মাগুরার পাকিস্তানি মিলেটারির সঙ্গে যুদ্ধ ও কপিলমুনি রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে স ম আলাউদ্দিনের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান  চির স্মরণীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, দৈনিক পত্রদূতের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নির্ভিক কলম সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ স ম আলাউদ্দিনের  প্রতি রইল আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)