শিরোনাম:
পাইকগাছা, সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২ ভাদ্র ১৪৩২

SW News24
রবিবার ● ১৭ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বিষের ফাঁদে মাছ শিকার; হুমকিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বিষের ফাঁদে মাছ শিকার; হুমকিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র
৩ বার পঠিত
রবিবার ● ১৭ আগস্ট ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বিষের ফাঁদে মাছ শিকার; হুমকিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র

---
প্রকাশ ঘোষ বিধান

সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যা বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন । এটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এবং এর বেশিরভাগ অংশই বাংলাদেশে পড়েছে। সুন্দরবনের কিছু অংশ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় এবং বাকি অংশ বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় অবস্থিত।

সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণীবৈচিত্র্য বিদ্যমান। প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা সুন্দরবনের কিছু এলাকা অভয়ারণ্যে ঘোষণা  করা হয়েছে। মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ এলাকা, যেখানে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যায়না এবং বন্য প্রাণীর জীবনে সামান্যই ব্যাঘাত না ঘটে।

তারপরও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে প্রজনন মৌসুমেও  মাছ শিকার করা থেমে নেই। পূর্ব ও পশ্চিম সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দেদার চলছে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার করা হচ্ছে। কিছু অসাধু জেলে বিষ ব্যবহার করে মাছ ধরায় বনের গহিনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, মাছের পোনা, অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। ফলে প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনে মাছ ধরা পাশ পারমিট বন্ধ রাখা হলেও মাছ শিকার বন্ধ নেই। এছাড়া সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ উপকূল এবং নদীর মোহনায় নেট জাল দিয়ে চিংড়ির পোনা ধরছেন স্থানীয়রা। জালগুলো মশারির মতো প্রায় নিশ্ছিদ্র। এতে চিংড়ির সঙ্গে নানা জাতের মাছের রেণু, পোনা, ডিমওয়ালা মা মাছ ও মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য-সামুদ্রিক প্রাণীর লার্ভাও মারা পড়ছে। সব মিলিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে বন ও উপকূলের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ।

সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে বন অপরাধ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ সময় দর্শনার্থী এবং সাধারণ জেলেরা না থাকার সুযোগে একাধিক অপরাধী চক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় চোরা শিকারিরা বনে প্রবেশের সময় তারা মহাজনদের দেওয়া কৃষিকাজে পোকা দমনে ব্যবহৃত ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড ও পেসিকল নিয়ে যান। সন্ধ্যা নামার আগে গহিন বনে অবস্থান নেন তারা। খালে মাছের ধরন বুঝে দুই ধরনের কীটনাশক বিষ ব্যবহার করেন তারা। একটা সাদা মাছের জন্য, আরেকটি চিংড়ির জন্য। জোয়ার হওয়ার কিছু আগে ভাত, চিড়া, পাউরুটি বা বিস্কুটের সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে খালের পানির মধ্যে ছিটিয়ে দেন। খালের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছোট ফাঁসের জাল পাতেন। ভাটার সময় পানি নামতে শুরু করলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিস্তেজ হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে এবং জালে আটকে যায়। তখন জেলেরা ওই সব মাছ সংগ্রহ করেন ।

প্রতি বছর ১ জুন থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় সুন্দরবনে সাধারণ মানুষের চলাচলসহ বনজীবীদের প্রবেশের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা থাকে। জুন থেকে আগস্ট-এই তিন মাস সুন্দরবনের নদী-খালের মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই তিন মাস সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এছাড়া এই সময়ে বন্যপ্রাণীরও প্রজনন মৌসুম। এই তিন মাস বনে পর্যটক ও বনজীবীরা না গেলে বনের জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী নিরুপদ্রব থাকে।

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ পূর্ব ও পশ্চিম এই দুটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। খুলনা ও সাতক্ষীরা অংশ নিয়ে পশ্চিম সুন্দরবন। আর বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা  ও খুলনার সামান্য অংশ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন। সুন্দরবনের এই দুই বিভাগের খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর,  বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ উপজেলার বেশিরভাগ বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। তাদের প্রায় অধিকাংশই বংশপরম্পরায় বনজীবী এবং সুন্দরবনসংলগ্ন নদ-নদীতে সারা বছর মাছ-কাঁকড়া ধরে এবং বনে গোলপাতা ও মধু আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

সুন্দরবন লাগোয়া এসব গ্রামগুলোর পুরুষরা সুন্দরবনে মাছ ধরা, গোলপাতা কাটা, কাঁকড়া ধরা ও মধু আহরণ করেন। আর নারী ও শিশুরা ব্যস্ত থাকেন চিংড়ির পোনা ধরা ও কাঠ সংগ্রহের কাজে। কিন্তু বর্তমানে নানা সংকট এসব বনজীবীদের জীবন-জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। এই অপতৎপরতার পেছনে কাজ করছে প্রভাবশালী কয়েকটি মহাজন গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী বন উপকূলের একশ্রেণির মাছ ব্যবসায়ী, যাদের বলা হয় কোম্পানি মহাজন। তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত জেলেদের প্ররোচনা দেন বিষ ছিটিয়ে দ্রুত বেশি মাছ শিকারে। অসাধু বনরক্ষী কোম্পানি মহাজনদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তারা অভয়ারণ্যের নদী-খালে ঢুকে বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দেন। এসব চক্রকে সহযোগিতা করছে উপকূল এলাকার এক শ্রেণির সাংবাদিক।

সুন্দরবনে সারা বছরই কিছু অপরাধ কর্মকাণ্ড চলে। বিশাল এ বনের সবখানে সারা বছরইচোরা শিকারীরা সক্রিয় থাকেন।
বনের অন্য সব খালের চেয়ে অভয়ারণ্যে বেশি মাছ পাওয়া যায়। যে কারণে অভয়ারণ্যের খাল দখল নিয়ে স্থানীয় মহাজনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। মহাজনরা দালালদের মাধ্যমে বন বিভাগের কিছু অসাধু  কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে অভয়ারণ্যের খাল দখল নেন। পরে তা জেলেদের কাছে চুক্তিতে ইজারা দেওয়া হয়। তবে বন্ধের  সময় বেশী টাকা দিতে হয়।

সুন্দরবনের অভয়ারণ্যের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে এ প্রবণতা বেড়েছে। আগে মৎস্যজীবীরা অভয়ারণ্য এলাকায় একটি-দুটি দল বিষ দিয়ে মাছ ধরতকিন্তু এখন সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ী মহাজন দাদনদাতা হয়ে গেছেন  সেখানেকার নিয়ন্ত্রক। তারাই এখন বনবিভাগের সঙ্গে রফা করেন। পরবর্তীতে বনের অভয়ারণ্যের বিভিন্ন নদী-খাল জেলেদের কাছে অলিখিত ইজারা দেন। এসব চক্র অবৈধ নানা উপায়ে সুন্দরবনের বনজসম্পদ আহরণ ও পাচারে জড়িত।

অসাধু কর্মকর্তা-প্রহরীদের যোগসাজশে পশ্চিম সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে খুলনার কয়রা ও দাকোপ এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগরকেন্দ্রিক কয়েকটি চক্র গড়ে উঠেছে। আর পূর্ব সুন্দরবনের বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জকেন্দ্রিক কয়েকটি চক্র রয়েছে । অসাধু কিছু বন কর্মকর্তা-প্রহরী বছরের পর বছর সুন্দরবনের একই এলাকায় দায়িত্ব পালন করায় এসব চক্রের সঙ্গে মিশে রয়েছেন। এদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয় এক শ্রেণির সংবাদকর্মী।

সুন্দরবন  বন বিভাগের  জনবল সংকটসহ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও সুন্দরবনকেন্দ্রিক সব ধরনের অপরাধ দমনে সচেষ্ট রয়েছেন বন কর্মকর্তা ও প্রহরীরা। প্রায়ই কীটনাশক, কীটনাশক প্রয়োগে ধরা মাছ, নিষিদ্ধ ঘন জাল ও হরিণ শিকারের ফাঁদ, মাংসসহ অনেককে আটক করা হচ্ছে। গহিন বনে বানানো শুঁটকির মাচা ধ্বংস করা হচ্ছে । সুন্দরবনে সারা বছরই বন বিভাগের নিয়মিত জোরালো টহল অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সুন্দরবনের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার, যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ। ১৩টি বড় নদীসহ ৪৫০টির মতো খাল রয়েছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের আয়তনের অর্ধেকের বেশি এলাকা এখন অভয়ারণ্য। এসব এলাকায় জেলেদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজপ্রাণী বাস করে । আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। শিলাসহ ১৪ প্রজাতির কাঁকড়ার প্রজননও হয় এখানে। পাশাপাশি এখানে ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। জোয়ারে পানিতে প্লাবিত হওয়া বনের জলাধার ভেটকি, রূপচাঁদা, দাঁতিনা, চিত্রা, পাঙাশ, লইট্যা, ছুরি, মেদ, পাইস্যা, পোয়া, তপসে, লাক্ষা, কই, মাগুর, কাইন, ইলিশসহ ২১০ প্রজাতির সাদা মাছের আবাস। রয়েছে গলদা, বাগদা, চাকা, চালী, চামীসহ ২৪ প্রজাতির চিংড়ি।

সুন্দরবন  বন বিভাগ বিষ দিয়ে মাছ শিকার ঠেকাতে বর্তমানে ড্রোন ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে সুন্দরবনে অবৈধভাবে প্রবেশ করা জেলেদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। জব্দ করা হচ্ছে বিষ এবং বিষ দিয়ে ধরা মাছ। বনের গহীন এলাকায় শুঁটকি তৈরির স্থান চিহ্নিত করে ধ্বংস করা হচ্ছে। সুন্দরবন সুরক্ষায় বন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কমিউনিটিভিত্তিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এর সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা সকলের জন্য অপরিহার্য।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)