বুধবার ● ১২ নভেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বেদেরা বাংলাদেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক এক যাযাবর গোষ্ঠী
বেদেরা বাংলাদেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক এক যাযাবর গোষ্ঠী
বেদেরা বাংলাদেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী। সাধারণত ওরা বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত। ভূমিহীন এই মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকায় বাস করে। বিশ্বায়নের সঙ্গে এ বিশাল জনগোষ্ঠী তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। তিন বেলা খাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বেদেরা বছরে ৬ থেকে ১০ মাস এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ভ্রমণ করে।
বেদে জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকা প্রধানত সাপ খেলা, সাপ বিক্রি, ভেষজ ও তাবিজ-কবচ বিক্রি, এবং বিনোদন; যেমন বানর খেলা, জাদু খেলা এর উপর নির্ভরশীল ছিল, যা তারা মূলত নৌকায় ভ্রমণ করে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে, এদের অনেকেই যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। অনেক গ্রামবাসী বেদেদের জাদুকরী শক্তিতে বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে বেদেরা জাদুকরী ক্ষমতার মাধ্যমে অশুভ আত্মাদের কারও শরীর ত্যাগ করাতে পারে। তাঁদের কেউ কেউ ঢাকা, চট্টগ্রাম, এবং খুলনার মতো বড় শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ভিক্ষাও করে।
কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শরণার্থী আরাকানরাজ বল্লাল রাজার সঙ্গে তারা ঢাকায় আসেন। পরবর্তীকালে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। তারা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করেন। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
বহুকাল ধরে তাদের নৌকাতেই বসবাস ছিল। বিভিন্ন নদীতে ছিল তাদের দল বেঁধে চলাফেরা। ছোট ছোট নৌকার বহর নিয়ে দেখা যেত এদের নদীবন্দরে। কিন্তু সময়ের আবর্তনে বাংলাদেশ থেকে নদীগুলো সংকুচিত হতে থাকে, সেই সঙ্গে সংকুচিত হয় বেদেদের জীবনও। এভাবে বেদেরা জীবনের তাগিদে একসময় উপকূলে আসা শুরু করে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বহু বেদে পরিবার এখন বসবাস শুরু করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে। ঢাকার সাভার, মুন্সিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরেরসরাই, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, ইত্যাদি জায়গায় এদের বসবাস দেখা যায়। একই সঙ্গে কূলে এসে বেদেদের জীবনে বেড়েছে নানাবিধ শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। একদিকে যেমন নেই তাদের নিরাপদ মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই, অন্যদিকে আছে পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ ও শিক্ষা–চিকিৎসাজনিত বিশাল সমস্যা। বর্তমানে বেদেরা সম্পূর্ণ ঠিকানাবিহীন ও অনিশ্চিত।
বেদেদের বাদিয়া, বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামেও ডাকা হয়। সাপের খেলা দেখানোর জন্যই এরা বেশি জনপ্রিয়। সর্বজনের কাছে বেদে সম্প্রদায় যাযাবর জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তারা দল বেঁধে ভ্রমণ করে এবং কখনো এক জায়গায় কয়েক মাসের বেশি থাকে না। বেদেরা একটি প্রান্তিক গোষ্ঠী। বাংলাদেশে প্রায় আট লাখ বেদে বাস করে। বেদেদের প্রায় ৯৮% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং প্রায় ৯৫% বেদে শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। ঐতিহাসিকভাবে বেদেরা ভোট দিতে পারতো না কারণ তাদের স্থায়ী আবাস ছিল না, একই কারণে তারা ব্যাংক ঋণ বা ক্ষুদ্রঋণের জন্য আবেদনও করতে পারতো না। ২০০৮ সালে বেদেরা বাংলাদেশে ভোটাধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়। বেদেরা দেশের সাভারসহ বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে এরা মূলত নৌকায় বসবাস করে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আটটি গোত্রে বিভক্ত এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারি, বারিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে প্রধান। মূল পেশা ক্ষুদ্র ব্যবসা হলেও শিঙ্গা লাগানো, তাবিজ বিক্রি, সাপ খেলা, সাপের কামড়ের চিকিৎসা, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য সেবাদান, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, কবিরাজি, বানরখেলা দেখানো, চুড়ি–ফিতা বিক্রি, জাদু দেখানো ইত্যাদি তাদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন। পুকুর, ডোবা বা জলাশয়ে কারও সোনা-রুপা হারিয়ে গেলে উদ্ধার করে দেয় তারা। নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে কোনোমতে বেঁচে আছে।
বেদেদের সার্বজনীন পেশা ছিল চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রি। নানা রকম বুনো শেকড়, লতাপাতা তারা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে। চিকিৎসাপদ্ধতিতে ঝাড়ফুঁক ও মন্ত্রের প্রয়োগ বেশি। বাত ও দাঁতের ব্যথার চিকিৎসা, শিশু চিকিৎসা, মালিশ প্রভৃতিতে বেদেরা অভিজ্ঞ বলে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল।
বর্তমানে বেদে চিকিৎসা গ্রহণে আধুনিক সমাজ অধিকতর সজাগ ও সচেতন। বেদে চিকিৎসা প্রণয়ন এখন আর লাভজনক নয়। গ্রামের মানুষের মধ্যেও এখন বেদে চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা নেই। তাই বেদেরা বাধ্য হয়েই পেশা পরিবর্তন করে চলছেন প্রতিনিয়ত। জীবিকার সন্ধানে ওরা ছুটতে থাকে এদিক–ওদিক। পুরোনো এই পেশা বদলে নতুন বেদে জীবিকার সন্ধান করছেন অনেকেই। গ্রামে ঘুরে ঘুরে অনেক বেদেই ফেরি করে বিক্রি করছেন সিরামিক পণ্য, বাচ্চাদের খেলনা, নারীদের শাড়ি-কাপড়।
অধিকাংশ বেদেদের কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং তারা চিকিৎসা সুবিধা ব্যবহার করে না। তাঁদের অধিকাংশই বাংলা ভাষায় কথা বলে। তাঁদের বেশিরভাগই মুসলিম; কিন্তু ইসলামের সাথে হিন্দুধর্ম, আধ্যাত্মবাদ এবং সর্বপ্রাণবাদ অনুসরণ করে থাকে। তারা অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় যাযাবর গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত, যেমন ডোম্বা এবং বুনো জনগোষ্ঠী। এরকম জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের একটি অকৃত্রিম যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়।






ভোলা সাইক্লোন ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস ঘোষণা করা হোক
রাসপূর্ণিমার আধ্য়াত্মিক তাৎপর্য
নিজ শহরকে বসবাসের যোগ্য করে তোলার দায়িত্ব শহরবাসীর
আলোর উৎসব দীপাবলি
নিরাপদ সড়ক সবারই কাম্য
অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের অবদান ও স্বীকৃতি
মায়াবী সুন্দরবন; বিস্ময়, ভয় আর হাজারো প্রতিকূলতা
মুখোশে চোখ সুন্দরবনে মানুষের জীবনরক্ষার এক অভিনব কৌশল
অর্থনীতির বিকাশে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ; এদের রক্ষা করুন 