শিরোনাম:
পাইকগাছা, রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২

SW News24
শুক্রবার ● ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » পরিবেশ » বিপন্ন শকুন উড়বে আকাশে
প্রথম পাতা » পরিবেশ » বিপন্ন শকুন উড়বে আকাশে
৬০৪ বার পঠিত
শুক্রবার ● ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বিপন্ন শকুন উড়বে আকাশে

প্রকাশ ঘোষ বিধান=---

প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে পরিচিত শকুন বর্তমানে পৃথিবীর মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। তীক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী শিকারী শকুন মৃত জীবজন্তুর মাংস খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পৃথিবীতে সর্বমোট ১৮ প্রজাতির শকুন রয়েছে। বাংলাদেশে আগে ছিল ৬ প্রজাতির শকুন। কিন্তু এখন কেবল ‘বাংলা শকুন’ই কোনমতে টিকে আছে বলে জানা গেছে। দেশীয় প্রজাতির এই শকুনের ইংরেজী নাম ডযরঃব-ৎঁসঢ়বফ াঁষঃঁৎব। বিশ্বে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শনিবার শকুন দিবস পালন করা হয়। বিলুপ্তপ্রায় এ শকুনকে বাঁচাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোই শকুন সচেতনতা দিবসের উদ্দেশ্য।

এক সময়ে যেখানে গরু, মহিষসহ গবাধি পশুর মৃতদেহ ফেলা হতো সেখানেই দলে বেধে হাজির হতো শকুন। শকুন অনেক উপর থেকে মৃত পশুর দেহ দেখতে পায়, সেখানে নেমে এসে মৃত পশুর দেহ দ্রুত সাবাড় করে দিত। বছর পর বছর ধরে এভাবেই শকুন প্রকৃতি থেকে মৃতদেহ অপসারণের কাজ করে রোগব্যাধী মুক্ত পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। গবাধি পশুর মৃতদেহের রোগ জীবানু এমনিতে সহজে মরে না। এগুলো সংক্রমিত হয়। মৃতদেহের রোগজীবাণু শকুনের পেটে দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। শকুনের পাকস্থলীর জারণ ক্ষমতা খুব বেশী। মৃত পশুর দেহ তো বটেই, তাদের হাড় পর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারে।  ফলে রোগ বিস্তার রোধ হয়। কিন্তু এখন আর আগের মতো শকুন দেখা যায় না। ফলে পরিবেশও আর আগের মতো প্রাকৃতিকভাবে পরিষ্কার হয় না, ফলে রোগজীবানু ছড়াচ্ছে।

শকুন পৃথিবীতে আছে প্রায় ২৬ লক্ষ বছর ধরে। সারা বিশ্বে সর্বমোট ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যেত, এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতির এবং পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ১১ প্রজাতির শকুন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুনের দেখা মিলতো। এর মধ্যে ৪ প্রজাতি দেশীয় আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। শকুন বা বাংলা শকুন ছাড়াও ছিল রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন-হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম জেপস বেঙ্গালেনসিস। গলা লম্বা, লোমহীন মাথা ও গলা গাঢ় ধূসর। পশ্চাদেশের পালক সাদা। পা কালো। ডানা, পিঠ ও লেজ কালচে বাদামি। এরা একই বাসা ঠিকঠাক করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, তাল প্রভৃতি বিশালাকার গাছে এরা বাসা বাঁধে। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শকুনের প্রজননকাল। গুহায়, গাছের কোটরে বা পর্বতের চূড়ায় ১-৩টি ডিম পাড়ে। ৪৫-৫০ দিনে ডিম ফোটে।

সারা পৃথিবী জুড়ে শকুনের অবস্থা খুবই নাজুক। গবেষকরা জানিয়েছেন পৃথিবীতে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ শকুনই এখন আর নেই। এজন্যেই পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, ক্যান্সার, পানি বাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এর ‘ক্রিটিক্যালি এন্ডেনজার্ড’ প্রাণীর তালিকায় রয়েছে শকুনের সব ক’টি প্রজাতি। বিগত ৩ দশকে বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ শকুন মারা গেছে। অবশিষ্ট এক ভাগও এখন মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। গবেষকরা শকুন কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন গবাদি পশুতে ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন ওষুধের ব্যবহার। এ ওষুধ প্রয়োগ করা কোন প্রাণীর মৃতদেহ শকুনের খাদ্য তালিকায় চলে এলে কিডনি নষ্ট হয়ে শকুনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আইইউসিএন-এর সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন উল্লেখ করেছে, কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সঙ্কট, কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ, ঘুড়ির সুতার সাথে জড়িয়ে পড়া, ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি কারণে শকুন বিলুপ্ত হচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপালে বেশী শকুনের বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ গবাদিপশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দু’টো ওষুধের প্রভাব মৃত গবাদিপশুর দেহেও থাকে। এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে এমন কোন মৃতদেহ খেলে শকুনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কেননা এর পার্শপ্রতিক্রিয়ায় শকুনের কিডনিতে পানি জমে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মাত্র ০.২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক যথেষ্ট একটি শকুনের মৃত্যুর জন্য। আগেই ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সম্প্রতিক সময়ে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হলেও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় এসব ওষুধের উৎপাদন ও মাঠ পর্যায়ে এসবের ব্যবহার প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। শকুন কমে যাওয়ার আরো একটি বড় কারণ প্রাণীটির বাসস্থানের অভাব। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রাচীন বৃহদাকার বৃক্ষরাজিতে বসতি গড়তো শকুন। শিমুল, নারকেল, তাল, দেবদারুর মত প্রাচীন বৃহদাকার গাছগুলো এখন আর চোখে পড়ে না।

১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে শকুনের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের মতো দেশে শকুনকে একটা উপদ্রব বলে মনে করা হতো। শকুন যে ভিষন উপকারী, তার সংরক্ষণ করা দরকার, সে কথা কারও মাথাতেই ছিল না।

প্রাণীকুলে শকুনের আধিপত্য বেশ আগেই ভেঙে তছনছ হয়েছে। এখন শুধু বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণী নয়, একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথেই বলা যায়। মাত্র তিন দশক আগেও কমপক্ষে ১০ লাখ শকুনের বিচরণক্ষেত্র ছিল দেশের আকাশ। সেটি ২৬০ এখন নেমে এসেছে। বাংলাদেশে বাংলা শকুন এখন মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে যে ক’টি শকুন আছে তার বেশির ভাগই রয়েছে সুন্দরবন এলাকায়। কিছু আছে শ্রীমঙ্গলের কালাছড়া ও হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গায়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ দেশ শকুন শূন্য হয়ে পড়তে পারে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যেই প্রায় ৯৯ শতাংশ শকুন হারিয়ে গেছে বলে। দেশে থাকা অল্পসংখ্যক শকুন রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন এর গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশে এক সময় রাজ শকুনের রাজত্ব ছিল। প্রায় ৪০ বছর হলো সেটি বিলুপ্ত হয়েছে। শকুনের সংখ্যা বাড়াতে আইইউসিএন বন অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে দেশে দুটি নিরাপদ জোন ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আশার কথা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শকুন সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশেও শকুন সম্পর্কে জন সচেতনতা বাড়ছে, গবেষণাধর্মী কাজকর্মও হচ্ছে। সিলেট ও খুলনা অঞ্চলে দু’টি সেফ জোন স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে শকুন সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রতি বছর অন্তত ১০ থেকে ১২টি শকুন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শকুনের এই সংকটের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে সচেতনতা। শকুন যে আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে শকুন হচ্ছে সবচেয়ে বিপন্ন মেরুদন্ডী প্রাণী। আমাদের সহানুভূতি ও ভালোবাসা তাদের দরকার।  তারা যেন আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে।

লেখকঃ সাংবাদিক





পরিবেশ এর আরও খবর

পাইকগাছায় পাখি শিকার রোধে বনবিবি’র লিফলেট বিতরণ পাইকগাছায় পাখি শিকার রোধে বনবিবি’র লিফলেট বিতরণ
পাইকগাছায় পাখি শিকার রোধে লিফলেট বিতরণ পাইকগাছায় পাখি শিকার রোধে লিফলেট বিতরণ
পাইকগাছায় পাখিদের নিরাপদ বাসা তৈরির জন্য গাছে মাটির পাত্র স্থাপন পাইকগাছায় পাখিদের নিরাপদ বাসা তৈরির জন্য গাছে মাটির পাত্র স্থাপন
শীতে বেড়েছে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য শীতে বেড়েছে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য
পাইকগাছায় পাখি সুরক্ষায় গণসচেতনতামূলক মাঠসভা ও গাছে পাখির বাসা স্থাপন পাইকগাছায় পাখি সুরক্ষায় গণসচেতনতামূলক মাঠসভা ও গাছে পাখির বাসা স্থাপন
পাইকগাছায় পাখির জন্য গাছে বাঁধা মাটির পাত্রে কাঠ বিড়ালিও বাসা বেধেছে পাইকগাছায় পাখির জন্য গাছে বাঁধা মাটির পাত্রে কাঠ বিড়ালিও বাসা বেধেছে
পাইকগাছায় বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত পাইকগাছায় বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত
পাইকগাছায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে শরতের কাশফুল পাইকগাছায় মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে শরতের কাশফুল
খুলনায় পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় করণীয় শীর্ষক কর্মশালা খুলনায় পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় করণীয় শীর্ষক কর্মশালা
পাইকগাছায় চেচুঁয়া ফজিলাতুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বনবিবির বৃক্ষরোপন পাইকগাছায় চেচুঁয়া ফজিলাতুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বনবিবির বৃক্ষরোপন

আর্কাইভ