শিরোনাম:
পাইকগাছা, শুক্রবার, ১৫ আগস্ট ২০২৫, ৩১ শ্রাবণ ১৪৩২

SW News24
বৃহস্পতিবার ● ৭ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রামের সম্মুখীন
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রামের সম্মুখীন
৮৪ বার পঠিত
বৃহস্পতিবার ● ৭ আগস্ট ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রামের সম্মুখীন

---আদিবাসী শব্দটি দ্বারা বোঝায় কোনো একটি অঞ্চলের প্রাচীনতম বাসিন্দা বা ভূমিপুত্র। বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ সরকার এই শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দগুলো ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আদিবাসী শব্দটি সাধারণত সেইসব জাতিগোষ্ঠীকে বোঝায় যারা কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাচীনতম বাসিন্দা এবং যাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তাদের বর্তমান আবাসভূমির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

আদিবাসী শব্দটির অর্থ হলো প্রথম বাসিন্দা বা মূল অধিবাসী। এটি এমন একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে বোঝায়, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে ঐতিহাসিকভাবে বসবাস করে আসছে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, রীতি-নীতি ও জীবনধারা বজায় রেখেছে। এই জনগোষ্ঠীগুলি সাধারণত প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল এবং প্রথাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাদের জীবন পরিচালনা করে।

প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরী মর্গানের মতে, কোনো স্থানে স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উদ্ভব-উৎপত্তি, ছড়িয়েপড়া, বিকশিত হওয়া কিংবা বসতি স্থাপন সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট ইতিহাস নেই তারাই সেই স্থানের আদিবাসী।

আদিবাসী বলতে ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দাদের বোঝায়, সাধারণত তারা উপজাতীয় মানুষ। ভারত ও বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু জনসংখ্যা নিয়ে গঠিত, যা ভারতের জনসংখ্যার ৮.৬% এবং বাংলাদেশের ১.১%, বা ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতে ১০৪.২ মিলিয়ন মানুষ এবং ২০১০ সালের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে ২ মিলিয়ন মানুষ। আদিবাসী সমাজগুলি তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, ছত্তিশগড়, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারত ও ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এবং বাংলাদেশের ফেনী, খাগড়াছড়ি, বান্দরছড়ি ও কক্সবাজারে বিশেষভাবে বিশিষ্ট।

আদিবাসী সমাজগুলি ভারতের আদি বাসিন্দা হিসাবে দাবি করা হলেও, সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার পতনের পরে বর্তমান অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, যা প্রাচীন শিকারী-সংগ্রাহক, সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা, ইন্দো-আর্য, অস্ট্রোএশিয়াটিক ও তিবেক-বর্মন ভাষাভাষী কাছ থেকে বিভিন্ন মাত্রার পূর্বপুরুষদের আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের মুন্ডা জাতির পূর্বপুরুষরা প্রায় ৪০০০-৩৫০০ বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে অভিবাসী হয়েছিল।

জাতিসংঘের আদিবাসি জনসংখ্যা সংক্রান্ত কর্মদলের (ডব্লিউজিআইপি) প্রথম সভা ৯ আগস্ট ১৯৮২-এ হয়েছিল এবং এই তারিখটি এখন আন্তর্জাতিক আদিবাসি দিবস হিসাবে পালিত হয়। প্রতিবছর ৯ই জুন যখন জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী শব্দটি স্বীকারই করতে চায় না। বাংলাদেশ সরকারের নীতি হচ্ছে, যাদের আদিবাসী বলা হচ্ছে তারা এখানকার আদি বাসিন্দা নয়। তারা হচ্ছে এ ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। সম্প্রতি বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, গণমাধ্যমে যাতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করা হয়।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তাদের ভূমি ও প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী যেমন চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, গারো, ওঁরাও, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো ইত্যাদি আদিবাসী হিসেবে পরিচিত।
ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৮৬০ সালে তৎকালীন চট্টগ্রামের পূর্ব অংশের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। ১৮৬৪ সালে তা স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা পায়। জেলার শাসন কর্তার পদবি ছিল সুপারিনটেনডেন্ট, সদর দপ্তর ছিল চন্দ্রখোনায় । ১৮৬৮ সালে তা রাঙামাটিতে স্থানন্তরিত হয়।

১৯০০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন এ্যাক্ট  নামে একটি আইন জারি করে। এই আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসিত হতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাকে ব্রিটিশ সরকার নন রেগুলেটেড এরিয়া বলে ঘোষণা দেয়।
১৯২০ ও ১৯২৫ সালে  চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন এ্যাক্ট সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে excluded area বা শাসন বহির্ভূত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও এ এলাকাকে excluded area হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাকে একটি পৃথক এলাকা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ নেতাদের প্রতি দাবি জানায়। এ দাবি ব্যর্থ হয় এবং নেতারা পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা, কুচবিহার, মেঘালয়, মিজোরাম প্রভৃতির সমন্বয়ে কতৃপক্ষের নিয়ন্ত্রনে একটি কনফেডারেশন গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু এ দাবি বাতিল হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের জড় ওঠে এবং অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়।
১৯৫৬ সালে সালে পাকিস্তান সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বিশেষ মর্যাদা (excluded area) অবসান ঘটানো হয় এবং উপজাতীয় জনগণ এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

আইয়ুব খানের শাসনামলে (১৯৫৭-১৯৬২) ১৯৫৮ সালে কাপ্তাই বাধ শুরু করা হয় এবং ১৯৬০ সালে শেষ হয়। আনুমানিক ৩০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে কাপ্তাই লেক তৈরি হয়। ফলে আধিবাসিদের ৪০ ভাগ চাষযোগ্য জমি প্লাবিত হয়। প্রায় ১ লক্ষ উপজাতি বাস্তুহারায় পরিণত হয়। এর ফলে আধিবাসিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

১৯৬৮ সালে আবার পাকিস্তান সরকার জনমতকে অগ্রাহ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ এলাকার মর্যাদা দিতে অনিহা প্রকাশ করে। ঘরবাড়ি, চাষযোগ্য জমি ও সম্পদ হারানোর বেদনায় এবং বিশেষ এলাকার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত উপজাতি জনগণের প্রায় ৫০ হাজার উপজাতি দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারত ও মায়ানমারে চলে যায়।

বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়, কারণ সরকার মনে করে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালো হতে পারে, যা সরকারের জন্য একটি রাজনৈতিক উদ্বেগের কারণ। আদিবাসী শব্দটি একটি জটিল এবং বিতর্কিত শব্দ যা কোনো অঞ্চলের প্রাচীনতম বাসিন্দা এবং তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে এই শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার এবং বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলি তাদের জীবনধারা, ভূমি ও সংস্কৃতি রক্ষায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে ভূমি অধিকার হরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং আধুনিকতার চাপে নিজস্ব সংস্কৃতি হারানোর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য। আদিবাসীরা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধির অংশ। তাদের জীবনধারা, জ্ঞান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয়। তাই, তাদের অধিকার ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)