মঙ্গলবার ● ২ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » প্রতিবন্ধী নাগরিক সমাজের বোঝা নয়
প্রতিবন্ধী নাগরিক সমাজের বোঝা নয়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
প্রতিবন্ধী আমাদের সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথচ তাদের নিয়ে অনেকেরই বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা থাকে। একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশকে প্রতিবন্ধীও অপ্রতিবন্ধী নির্বিশেষে সবার জন্য বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।
প্রতিবন্ধী শারীরিক বা মানসিক যেটাই হোক প্রতিবন্ধিত্ব মানেই অসহায়ত্ব। অসহায় ও দুর্বলের ওপর অবহেলা অবজ্ঞা, নির্যাতন সৃষ্টির শুরু থেকে সব সমাজ ব্যবস্থায় ছিল এখনও আছে। প্রতিবন্ধী সম্প্রদায় অসহায় ও দুর্বল মানুষ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী দিবসের অনুগামিতার পিছনে আছে এক ঘটনাবহুল জীবনস্মৃতি। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বেলজিয়ামে এক সাংঘাতিক খনি দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যান। আহত পাঁচ সহস্রাধিক ব্যক্তি চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাদের প্রতি সহমর্মিতায় ও পরহিতপরায়ণতায় বেশ কিছু সামাজিক সংস্থা চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে স্বতঃপ্রবৃত্ত ভাবে এগিয়ে আসে। এর ঠিক পরের বছর জুরিখে বিশ্বের বহু সংগঠন সম্মিলিত ভাবে আন্তর্দেশীয় স্তরে এক বিশাল সম্মেলন করেন। সেখানে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবন্ধী কল্যাণে বেশকিছু প্রস্তাব ও কর্মসূচি গৃহীত হয়। খনি দুর্ঘটনায় আহত বিপন্ন প্রতিবন্ধীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালন করতে আহ্বান জানানো হয়। সেই থেকেই কালক্রমে সারা পৃথিবীর প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দিন হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব জুড়ে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও সুরক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে উদযাপন করা হয় বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। ৩ ডিসেম্বর বিশ্ব ও জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী মানুষদের অন্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি যত্নের প্রয়োজন পড়ে। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই দিবসটির সূচনা হয়।
প্রতিবন্ধী নাগরিকের সমাজে অন্যসব নাগরিকের মতো সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার মানবাধিকার ও সংবিধান স্বীকৃত। প্রতিবন্ধী মানুষের রয়েছে নানা রকম প্রকারভেদ। শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী, বাকপ্রতিবন্ধী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এমনকি বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী এই মানুষগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে জীবনযুদ্ধ পরিচালনা করছে। দেশে নারী, পুরুষ, হিজড়াসহ বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা ৩৫ লাখ। বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১.৩ বিলিয়ন মানুষ উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা ভোগ করে, যা বিশ্ব জনসংখ্যার ১৬ ভাগ যা প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা বেশি। প্রতিবন্ধীর ২ দশমিক ৯২ শতাংশ গ্রাম বসবাস করে, ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ থাকে শহরে।
প্রতিবন্ধীদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধীর হার সর্বোচ্চ বলে জরিপে দেখা গেছে। ২ দশমিক ৮০ শতাংশের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধীর হার ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। অন্য ধরনের প্রতিবন্ধীর মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ, বাকপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ১৪ এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধী শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ। মাত্র ২৭ দশমিক ২১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদ কাজে নিযুক্ত আছেন।
যেকোনো মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তার প্রাক- শৈশবকাল, অর্থাৎ শূন্য থেকে পাঁচ বছর। এ সময় একজন মানুষের মস্তিষ্কের ৯০ শতাংশ বিকাশ ঘটে। এ সময় সামান্যতম অবহেলা হতে পারে শিশুর জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ।
দুর্ঘটনা ছাড়াও জন্মগতভাবে,পুষ্টির অভাবে, অসুখে-বিসুখে মানুষ প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়। প্রতিবন্ধীতা শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টিজনিত, বাক ও শ্রবণজনিত কিংবা বহুমাত্রিক হতে পারে। প্রতিবন্ধীতার কোনো প্রতিষেধক না থাকলেও আছে প্রতিরোধের উপায়। দুর্ঘটনাজনিত কারণে মানুষ বয়সের যে কোনো স্তরে প্রতিবন্ধী হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য যেসব কারণে প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিতে পারে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কম বা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ, মায়ের অপুষ্টিজনিত সমস্যা, শিশু গর্ভে থাকাবস্থায় মা রোগাক্রান্ত বা দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, ভুল চিকিৎসা গ্রহণ, প্রসবকালীন সমস্যা কিংবা শিশু জন্মের পর রোগাক্রান্ত হওয়া বা মাথায় আঘাত পাওয়া অথবা অপুষ্টির শিকার হওয়া। অজানা অনেক কারণেও শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। জন্মের সময় মস্তিষ্কের বিন্যাস অথবা জিনগত অস্বাভাবিকতাসহ জন্ম নেয়া শিশু প্রতিবন্ধী হয়। সে জন্য প্রতিবন্ধিতার কারণগুলো যেমন জানতে হবে তেমনি সবার মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। প্রতিবন্ধিতা রুখে দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো প্যারেন্টিং এডুকেশন। এর মাধ্যমে মা-বাবাকে শিশুর যত্নে যথাযথভাবে সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব।
দেশে সকলের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত। বিলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা থাকলে প্রতিবন্ধী শিশু ভর্তি হতে পারবে উল্লেখ থাকলেও সব স্কুলে তারা ভর্তি হতে পারছে না। প্রতিটি জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের এবং সমাজের উন্নয়নে সংগঠিত হয়েছে। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে এবং তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারী -বেসরকারী পর্যায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহযোগিতা করা প্রয়োজন। তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে সুন্দর এই পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
প্রতিবন্ধীতা মানে শারীরিক অসম্পূর্ণতা নয়। প্রতিবন্ধীরা আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বোঝা মনে হলেও প্রতিবন্ধী সমাজের বোঝা নয়। যথাযথ সুযোগ সুবিধা পেলে প্রতিবন্ধীরাও অনেক কিছু করতে পারে। সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন ও সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রতি মানুষের কর্তব্য।
প্রতিবন্ধী শব্দটি দ্বারা ত্রুটি বা শারীরিক অসম্পূর্ণ ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। এটি কোন ব্যক্তির পরিচয় নয়। প্রতিবন্ধী বলে কাউকে আলাদা করে দেখা উচিত নয়। মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা।
সমাজের অবিচ্ছেদ্য এ অংশকে সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা খুবই জরুরি।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট






আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস
দর্শকদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম টেলিভিশন
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় টয়লেটের গুরুত্ব অপরিসীম
বেদেরা বাংলাদেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক এক যাযাবর গোষ্ঠী
ভোলা সাইক্লোন ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস ঘোষণা করা হোক
রাসপূর্ণিমার আধ্য়াত্মিক তাৎপর্য
নিজ শহরকে বসবাসের যোগ্য করে তোলার দায়িত্ব শহরবাসীর
আলোর উৎসব দীপাবলি
নিরাপদ সড়ক সবারই কাম্য 