শিরোনাম:
পাইকগাছা, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

SW News24
শনিবার ● ৪ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » তামাক মুক্ত দেশ গড়তে সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » তামাক মুক্ত দেশ গড়তে সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন
৮৪৫ বার পঠিত
শনিবার ● ৪ জুন ২০১৬
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

তামাক মুক্ত দেশ গড়তে সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

 ---     প্রকাশ ঘোষ বিধান

ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পৃথিবীর সকল দেশে এটি সর্বজন স্বীকৃত। ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ দিবসটি পালিত হয়। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই দিন থেকে তামাক বা ধুমপান ছেড়ে দিয়ে তামাকমুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া। বাংলাদেশে তামাক বর্জনে সচেতনার লক্ষে সরকার, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো নানা ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সাথে বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগের প্রেক্ষিতে তামাক বর্জনে সচেতনতা এবং আন্দোলন অনেকাংশে গতিশীল হয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও তামাক কোম্পানি গুলোর আগ্রসী প্রচারণা এবং উদ্ধুদ্ধকরণ কার্যক্রমে তামাক বিরোধী প্রচারণা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। তামাকের বিজ্ঞাপন প্রচারণা দণ্ডনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও বিভিন্ন সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল কোম্পানি তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে নানা কৌশলে।

ধুমপান মৃত্যুর জন্য দায়ী, তবু কেন ধুমপান। ধুমপান রোধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইন রয়েছে। তামাক ব্যবহার কমাতে বিশ্বের ৭৭টি দেশে এরই মধ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা দেওয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে নীতিমালা করা হলেও এখনো তা শতভাগ মানা হচ্ছে না। আমাদের দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী পাবলিক প্রেস ও গণ পরিবহনে ধুমপান দণ্ডনীয় অপরাধ। এ আইন অমান্য করলে জরিমানার বিধান রয়েছে। ১৮ বছেরের কম বয়সীদের (নারী-পুরুষ) কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির উপর নিষেধাক্ষা থাকলেও আইন মানছে না। প্রকাশ্যে শিশু-কিশোরদের ধুমপান করতে দেখা যাচ্ছে। মহিলারাও তামাকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। সিগারেট, গুল, জর্দা ও তামাকপাতা সেবনকারী মহিলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আইন, কঠোর, বিধান, জরিমানা বা প্যাকেটে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ছবি ছাপানোর পরও ধুমপায়ীদের দমানো যাচ্ছে না।

ধুমপানসহ তামাক ব্যবহারের হার বেড়ে চলেছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ধুমপান, তামাকজাত দ্রব্যর ব্যবহারের হার ছিল ৪৩.২ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে দাড়িয়েছে পুরুষ ৫৮ শতাংশ ও মহিলা ২৯ শতাংশ। বিড়ি বা সিগারের মাধ্যেমে ধুমপান করে ৪৫ শতাংশ পুরুষ এবং ১.৫ শতাংশ মহিলা। চর্বনযোগ্য তামাক ব্যবহারে পুরুষের চেয়ে নারীরা এগিয়ে। এ ক্ষেত্রে নারী ২৭.৯ শতাংশ এবং ২৬.৪ শতাংশ পুরুষ। দেশে ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ নানা ভাবে তামাক সেবন করছেন। ২ কোটি ১৪ লাখ পুরুষ ও ৭ লাখ মহিলা ধুমপান করে থাকেন। এ ছাড়া ১ কোটি ২৫ লাখ পুরুষ ও ১ কোটি ৩৪ লাখ মহিলা চর্বনযোগ্য তামাক ব্যবহার করেন। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে প্রতিদিন তামাক জনিত রোগে ১৫৬ জন মৃত্যুবরণ করছেন। বছরে ৫৭ হাজার ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করছে এবং ৩ লাখ ৮২ হাজার পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এছাড়া ধুমপানের কারণে কমক্ষেত্রে ১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ বছর বয়সের আগেই যারা তামাকে আসক্ত হয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে নিকোটিন নির্ভরতা এবং আমৃত্যু তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। গ্লোবাল স্কুল-বেজড হেলথ সার্ভে, ২০১৪ (জিএসএইচএস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষনায় জানাযায়, বিশ্বের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্টীর (নারী-পুরুষ) তিন ভাগের একভাগ ধুমপায়ী। বিশ্বে প্রতিবছর তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারে ৮০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। এক জরিপে দেখা গেছে। ধুমপায়ীদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪৫ ভাগ ব্যক্তি মাসের অধিকাংশ দিন কাঁজে ফাকি দেয়। শতকরা ১৪ থেকে ১৭ ভাগ শারীরিক অক্ষমতার কারণে কাজ বাদ দেয়। ধুমপানে অনিদ্রা, হৃদকস্পন, বদহজম, স্ট্রোক, ক্যান্সার, পেপটিক, আলসার ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। নারী ধুমপায়ীরা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর গর্ভাবস্থায় ধুমপান করলে সন্তানের দেহে কার্বন মনোক্সাইড সরবরাহ করে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি রোধসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। ধুমপায়ীরা শুধু নিজের ক্ষতি করে না, তারা অধুমপায়ীদেরাও ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। ধুমপায়ীদের সিগারেটের ধোয়ার কারণে চারপাশের সবাই ঝুঁকিতে থাকে। পিতা বা অভিভাবকদের ধুমপানে শিশুরা, অফিস-আদালতে সহকারি এবং ধুমপায়ী স্বামীর কারণে পরোক্ষভাবে স্ত্রীরা হৃদরোগ, নিউমেনিয়া, ফুস ফুস ও গলায় ক্যান্সার এমনকি গর্ভে তারা মৃত শিশু, ওজন কম ও বিকালঙ্গ শিশুদের জন্ম দিচ্ছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুভাবেই মহিলাদের উপর তামাকের প্রভাবে কাজ করছে। দেখা যায়, শিশু-কিশোররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুকরণ বা ফ্যাশান থেকে ধুমপানে অভ্যস্থ হয়। আর অল্পবয়সে ধুমপানে অভ্যস্থ কিশোররা দীর্ঘ আয়ু লাভ করে না। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরাই ৬৫-৭০ বছর বয়সের মধ্যে মারা যায়। স্বাভাবিক বয়স সীমার চেয়ে করা কম বছর বাঁচে।

ধুমপান স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিকর। তামাক বা ধুমপানের কারণে নিকোটিন বিষে মৃত্যু বরণ করছে। অনেকেই রোগাক্রান্ত হচ্ছে। ধুমপান মারাত্মক বিষাক্ত ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরুপ। ক্যান্সারের অন্যতম কারণ ধুমপান। এ সংগে সেবনকারী, উৎপাদক, বিপননকারীসহ সবাই একমত পোষন করেন। তবুও ধুমপায়ীদের দমানো যাচ্ছে না। তবে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে দিন দিন প্রচার বাড়ছে সেই সাথে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমানে পৃথিবীর ১২৫টিরও বেশি দেশের প্রায় ৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়। শীর্ষ তামাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ। বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম, মাত্র ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৭ হাজার একর। অথচ তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিশ্বের মোট তামাকের ১ দশমিক ৩ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। সর্বশেষ কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ- ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণ ৯৯ লাখ ৬২৪ একর।

তামাক চাষ কৃষকের স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য এবং সার্বিকভাবে গোটা জনস্বাস্থ্য ও পৃথিবীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। তামাক চাষে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে, তাই এই জমিতে অন্যান্য ফসল উৎপাদনের ক্ষমতাও কমতে থাকে। উৎকৃষ্ট মানের জমি ক্রমবর্ধমানহারে তামাকচাষে ব্যবহৃত হওয়ায় খাদ্য ফসলের জমি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বন নিধনের পেছনে তামাক চাষ দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার তিনটি উপজেলায় তামাকপাতা শুকানোর (কিউরিং) কাজে এক বছরেই প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে।

সচেতনতার মাধ্যমে তামাক ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণকরা সম্ভাব। ধুমপানের বদাভ্যাস বর্জনে গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক ও বেসরকারী সেবা প্রতিষ্ঠান গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। তামাক বর্জনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশ সহ অধিকাংশ দেশে তামাকের প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেছে। উন্মুক্ত স্থানে তামাক মুক্ত রাখতে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা দরকার। এর ফলে ব্যবহারকারীরা প্রকাশ্যে তামাক ব্যবহার করবে না। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং জন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাহলে বিপুল পরিমাণ টাকা অপচয় থেকে বাঁচানো যেত। আর সেই সাথে দেশের মৃত্যুর হার কমবে। সব থেকে কল্যাণ কর, ধুমপান বর্জনের জন্য ধুমপায়ীদের দৃঢ় ইচ্ছা শক্তিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তামাক ব্যবহার থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে এবং একটি স্বাস্থ্যকর জাতি গড়তে সমন্বিত প্রাথমিক হস্তক্ষেপ এবং প্রতিরোধমূলক প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ