শিরোনাম:
পাইকগাছা, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৮ আশ্বিন ১৪৩২

SW News24
বৃহস্পতিবার ● ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সেকালের বারোয়ারি পুজো বদলে গিয়ে আজকের সর্বজনীন দুর্গা পূজা
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সেকালের বারোয়ারি পুজো বদলে গিয়ে আজকের সর্বজনীন দুর্গা পূজা
৭৬ বার পঠিত
বৃহস্পতিবার ● ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

সেকালের বারোয়ারি পুজো বদলে গিয়ে আজকের সর্বজনীন দুর্গা পূজা

---প্রকাশ ঘোষ বিধান

শুভ মহালয়ার সুরের সাথে সাথেই বেজে উঠেছে দেবীর আগমনী বার্তা। দুর্গাপূজাকে শারদীয় পূজা বলা হয়। কারণ দেবীর আগমন শুরু হয়েছে মহালয়ার মধ্য দিয়ে শরৎকালে। প্রকৃতিতে শরৎ বিরজমান। শারদ প্রাতে দেবীর আগমন ঘটে।

দুর্গা পূজার একাল-সেকাল। এই সময়-সেই সময়। প্রাচীনকাল, আবহমানকাল ও বর্তমানকাল। বর্তমান সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে  দুর্গাপূজা পারিবারিক, বারোয়ারি ও এখন সর্বজনীন। সেকালের  বারোয়ারি পুজোই আজ আধুনিকতার মোড়কে পোশাকি নাম সর্বজনীন পূজা। দুটো শব্দই খুব পুরোনো নয়। সর্বজনীন পূজার বয়স  সত্তর-পঁচাত্তর বছরের বেশি। আর বারোয়ারি পুজোর বয়স মাত্র দুশো বছরের হয়ত কিছু বেশি।

সেকালের সীমিত সাঙ্গীতিক পরিবেশ থেকে এখনকার আধুনিক ও উচ্চ শব্দে পূজার ঐতিহ্য পরিবর্তিত হয়েছে। দুর্গাপূজা এখন আর বর্ণ-গোত্র নির্ভর নয়, বরং সকল ধর্মের মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্যাপিত হচ্ছে পূজা। পূজার ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত তো আছেই। বর্তমান সময়ে উদ্যাপন, মণ্ডপ তৈরিতে শৈল্পিক নানা প্রচেষ্টা দেখা যায়। আলোকসজ্জায় প্রযুক্তি উন্নয়নের ধারা যোগ করেছে আশ্চর্য রকম বৈচিত্র্য।

দুর্গাপূজার সেকাল এবং একাল সময়ের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, সেকালের দুর্গাপূজা ছিল মূলত একটি ধর্মীয় ও পারিবারিক উৎসব, যা ঐতিহ্যবাহী নিয়ম-কানুন ও দেবীর আরাধনার উপর কেন্দ্র করে হতো। অন্যদিকে, একালের দুর্গাপূজা একটি সর্বজনীন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, যেখানে আড়ম্বরপূর্ণ মণ্ডপসজ্জা, আধুনিক আলোকসজ্জা, ডিজে, শব্দ দূষণ, এবং নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হয়, যা মূল আধ্যাত্মিক ভাবকে অনেক সময় ছাপিয়ে যায়। সেকালে দুর্গাপূজা ছিল মূলত দেবীর উপাসনা ও মহিষাসুর বধের প্রতীকী উদযাপন। ধূপ-ধুনোর ব্যবহার, মন্ত্র পাঠ এবং চণ্ডী পাঠের মাধ্যমে দেবীর আরাধনা করা হতো।

আধুনিক বা একালে পুজায় বিশাল আকারের মণ্ডপ, জমকালো প্রতিমা, এবং আলোকসজ্জার প্রতিযোগিতা দেখা যায়। ক্লাব ও পূজা কমিটিগুলি একে অপরের থেকে বড় এবং আকর্ষণীয় মণ্ডপ নির্মাণের চেষ্টা করে। ঢাকের শব্দের পাশাপাশি ডিজে, আধুনিক সঙ্গীত এবং নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পূজার অন্যতম আকর্ষণ। দুর্গাপূজা এখন একটি বড় বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, যেখানে কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া ও বিভিন্ন বিনোদনের মাধ্যমে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হয়।

দুর্গাপূজা মানেই উৎস-আনন্দের মুহূর্ত। বহুকাল ধরেই বাঙালির আবেগের জায়গার একটি দুর্গাপূজা। আগেও সেটাই ছিল, এখনো আছে। দুর্গাপূজা মানেই মনের গভীরে গাথা টুকরো টুকরো স্মৃতি। পূজার উৎসব-আনন্দ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। দুর্গাপূজার সেকাল ছিল সীমিত আকারে, দুর্গাপূজা মূলত জমিদার বাড়ি বা বনেদি বাড়িতে এবং সীমিত সংখ্যক মানুষ উপভোগ করত। পূজার সময় কোনো উচ্চ শব্দ বা আধুনিক যন্ত্রসঙ্গীত থাকত না, মূলত ঢাকের শব্দই প্রধান ছিল, যা পূজার এক শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ তৈরি করত। পূজার সময় সারাবছর শিল্পীরা অপেক্ষা করতেন, আর সেকালের গ্রামীণ বা সীমিত জগতের মহিলারা নাটক ও জলসার মাধ্যমে বিনোদন পেতেন।

কিন্তু একালের দুর্গাপূজা সর্বজনীন, জাকজমকপূর্ণ এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে, যেখানে প্যান্ডেল, ডিজে বক্স, আধুনিক সাজসজ্জা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব দেখা যায়, তবে ঐতিহ্যবাহী ঢাকের শব্দ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ কমে গেছে। একালের দুর্গাপূজা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, যেখানে ক্লাব, সমিতি, বা পূজা কমিটিগুলো অংশগ্রহণ করে।
এখনকার পূজায় প্যান্ডেল, ডিজে বক্স, আলো, ও আধুনিক সাজসজ্জার ব্যবহার দেখা যায়। দুর্গাপূজার প্রতিমা, মণ্ডপ ও অন্যান্য আয়োজনে আধুনিক শিল্পীদের প্রভাব দেখা যায়। একালের পূজায় আধুনিকতা বাড়লেও ঢাকের শব্দ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ঐতিহ্য অনেকটাই কমে গেছে।

মর্ত্যে দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন করেন রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য, যা আধুনিক কালের দুর্গাপূজার ব্যাপকতার তুলনায় ভিন্ন।   মেধস মুনি তাঁদের দু-জনকে মা দুর্গার আরাধনা করতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। বঙ্গাধিপতি রাজা সুরথকে চৈত্রবংশীয় রাজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে।বাংলায় দুর্গাপূজা কবে শুরু  হয়েছিলো এ নিয়ে পণ্ডিত-গবেষকের নানা মত থাকার পরেও মোটামুটি একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, ষোড়শ শতকে সম্রাট আকবরের শাসনামলে রাজশাহীর তাহিরপুর অঞ্চলের সামন্ত রাজা কংস নারায়ণ ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম মহাআড়ম্বরে শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপন শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে বাঙালি জমিদারদের মধ্যে এই দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি হিন্দুদের জীবনে নেমে এসেছিল অভিশাপ। তখনকার সময়ে হিন্দু হলেই নেমে আসত অবর্ণনীয় অত্যাচার। রমনা কালীমন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দির, শাঁখারীবাজারের মন্দির, চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম মন্দিরসহ হাজার হাজার মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। ১৯৪৭ সালের পরে অভিজাত ও বিত্তশালী হিন্দুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে শুরু করলে তখন থেকে সর্বজনীন পূজা ব্যাপক আকারে শুরু হয়। এর ফলে হিন্দু সমাজের সব বর্ণের মানুষদের সম্মিলিতভাবে পূজা করার প্রচলন শুরু হয়। সম্মিলিত পূজাকেই বলে বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা। তবে সমাজে পারিবারিক ও বারোয়ারি দুই ধরনের পূজার প্রচলন আছে।

পূজার সময় অভিভাবকরাই নিজেরাই পছন্দ করে পরিবারের সকলের জন্য পূজার জামা-কাপড় ইত্যাদি কিনে আনতেন, পরিবারের সদস্যরা সকলে আনন্দচিত্তে তার গ্রহণ করতো।  তাই পরেই তারা পূজার কয়টা দিন পুজো বাড়িতে গিয়ে আনন্দ করতো।
কারণ আগেকার দিনে মানুষ বারোমাস নির্দিষ্ট দোকান থেকেই বাকীতে জামা-কাপড় কিনতো। হালখাতায় সব টাকা পরিশোধ করতো।  এখন  অভিভাবকদের আর সে স্বাধীনতা নেই। সে স্বাধীনতা চলে গেছে ছেলেমেয়েদের হাতে। সকলেই ফ্যাশানেবল জিনিস চায়, তা না হলে বন্ধু–বান্ধবদের কাছে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। সে জন্য তাদেরকে নিয়ে যেতে হয় বড় বড় শহরগুলোতে অবস্হিত শপিং মলে, নিউমার্কেট, বিখ্যাত জায়গায়। যেটা পছন্দ করবে, সেটাই কিনে দিতেই হবে নগদ মূল্যে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শহর ও গ্রামে খুব অল্পই বারোয়ারি দুর্গাপূজা হত। দু-তিনটে পাড়া বা গ্রাম মিলে একটা বারোয়ারি পুজো করতো। বারোয়ারি দুর্গাপূজা সর্বজনীন রূপ নিল। ক্রমেই দুর্গাপূজা সংখ্যা বাড়তে থাকল। শুরু হলো এক পূজা কমিটির সঙ্গে অন্য পূজা কমিটির রেষারেষি। আগে পূজায় সমবেত অংশগ্রহণ এক অদ্ভূত আনন্দ ও উন্মাদনা সৃষ্টি করতো। আজকের সর্বজনীন দুর্গোৎসবে মাইকের কর্কশ শব্দে ঢাকের বাজনা চাপা পড়ে গেছে। ঢাকীরা, ঢাক বাজিয়ে আনন্দ দিতে পারে না। আজকের পূজায় ভক্তিভাবনা গৌণ হয়ে গেছে। বেশি ভাগ সর্বজনীন দুর্গোৎসবে পূজার মাইকে আগেকার সেই আনন্দের উচ্ছ্বাস আগমনীর গান বাজে না। তাঁর পরিবর্তে শুনতে পাই চটুল হিন্দি ও বাংলা গান। রুচিহীন  হই -হুল্লোর জায়গা করে নিয়েছে। রুচিশীল মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। মায়ের প্রতি নিষ্ঠা ও ভক্তিতেও ভাঁটা পড়ে গেছে। তবে অতীত ঐতিহ্যকে অনেকেই বজায় রাখতে পারছে না। আবার কেউ কেউ আজো বজায় রেখে চলেছে বা চেস্টা করছে।

সময়ের হাত ধরে সেকালের বারোয়ারি পুজো বদলে গিয়ে আজকের সর্বজনীন পূজার মহিমা লাভ করেছে। সেকাল থেকে একালে বারোয়ারি বা সর্বজনীন দুর্গোপুজোয় যে শুধু একটা রূপান্তর এসেছে তাই নয়, বলা যায় ঘটে গেছে একটা মহাবিপ্লব। এখনকার বড় পুজো মানেই প্যাণ্ডেলের কারুকার্যে, লাইটিং-এর জাঁকজমকে প্রতিমার রূপ সজ্জায় একে অপরের টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা। প্রতিমার সাজসজ্জা ও রূপসজ্জা এবং বিন্যাসে নতুন আঙ্গিকের সৃষ্টি করা। তাজা ফুলের মালা হারিয়ে গেছে। মালা গাঁথার দিন শেষ হয়ে গেছে। গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যেই একালের পুজো প্লাস্টিকের ফুলে আমূল বদলে গেছে। নব্বই দশকে এই বদলের শুরু। আজকের সময়ে তা পল্লবিত হয়েছে ব্যাপক ভাবেই।

আধুনিক শিল্পকলা ও সিনেমার প্রভাব প্রতিমা নির্মাণ ও মণ্ডপের সজ্জায় লক্ষ্য করা যায়, যা প্রতি বছর নতুনত্বের ছোঁয়া আনে। ঐতিহ্য ও ধর্ম শাস্ত্র মতে, হিন্দুধর্মে সোনা জ্ঞান, শিক্ষা, এবং ধার্মিকতার প্রতীক, এবং এটি প্রায়শই দেবদেবীদের মুকুটে ব্যবহৃত হয়। দুর্গার মহিমাসজ্জিত রূপ অপরিহার্য। দেবী দুর্গার রঙ এর সাথে অসুরের রঙ এক হবে না। তবে এখন ধর্মীয় শাস্ত্র মত না মেনে নানা বর্ণের প্রতিমা তৈরি করছেন।

সময়ের পরিক্রমায় এখন অনেকেই নিজের মতো করে দেবীকে সাজিয়ে তোলেন। আধুনিক অনাধুনিক বেশভূষা ও সরঞ্জামাদির দেখাও মিলে দেবীর হাতে। এতে দেবীকে তাদের মতো করে পাওয়ার বাসনা হয়তো তৈরি হয় কিন্তু স্বাত্তিকরূপে দেবী সন্তুষ্ট হয় কি না তা প্রশ্ন থেকে যায়। তবে শাস্ত্র পাঠ বোঝা যায়, দেবী অপার মহিমা সম্পন্না, মাতৃগুণ সম্পন্ন দেবী দুর্গা ভক্তদের এমন পাগলামিকে সহজভাবেই দেখেন।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ