মঙ্গলবার ● ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মানুষের আনন্দ আতশবাজির বিকট শব্দ ও উজ্জ্বল আলোয় আতঙ্কিত প্রাণকিূল
মানুষের আনন্দ আতশবাজির বিকট শব্দ ও উজ্জ্বল আলোয় আতঙ্কিত প্রাণকিূল
প্রকাশ ঘোষ বিধান
নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বা জমকালো কোন অনুষ্ঠান মানুষের উৎসব-উদ্দীপনার শেষ থাকে না। আর এই উদযাপনের অন্যতম একটি অংশ আতশবাজি। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে আতশবাজি ফোটানো। আতশবাজি হচ্ছে নিম্নমাত্রার বিস্ফোরক নান্দনিক এবং বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে বহুল ব্যবহৃত এক ধরনের বাজি। মূলত চারটি প্রাথমিক রূপ আছে আতশবাজির। শব্দ, আলো, ধোঁয়া ও ভাসমান উপকরণ। এগুলি রঙিন শিখা যেমন লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগুনি এবং সিলভারসহ নানান রঙের ঝলক সৃষ্টি করতে সক্ষম। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী, খেলা এবং বহু সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আতশবাজির ব্যবহার হয়।
আতশবাজিতে পাখির মৃত্যু কাম্য নয়। আতশবাজির বিকট শব্দ ও এর উজ্জ্বল আলোর কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে, যার ফলে উড়ন্ত অবস্থায় ভবন বা বৈদ্যুতিক তারে ধাক্কা লেগে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বা বাসা থেকে পড়ে বহু পাখির মৃত্যু ঘটে। যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর।
আতশবাজি ফোটানো মানুষের কাছে আনন্দের হলেও বিভিন্ন প্রাণি বিশেষ করে পাখির জন্য এটি বড় আতঙ্ক। আতশবাজির তীব্র শব্দ সাথে আলোক ঝলকানির কারণে শত শত পাখিরা বাসা থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। এরপর অন্ধকারে বিভিন্ন বাসাবাড়ির জানালায় ও বিদ্যুতের তারে ধাক্কা খেয়ে এসব পাখি মারাও যায়।পাখির যোগাযোগের মাধ্যম শব্দ। অতিরিক্ত শব্দের কারণে পাখি চলাচলের রাস্তা ভুলে যেয়ে আর ফিরতে পারে না। উচু দেওয়ালের সঙ্গে আঘাত খেয়ে অনেক পাখি মারা যায়। তাই বছরের অন্যান্য রাতের তুলনায় নববর্ষের এই রাতে পাখিদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সম্ভাবনা হাজার গুণ বেশী থাকে।
আতশবাজীর শুরুটা চীন থেকেই। নানান অনুষ্ঠানে চীনাদের আতসবাজির ব্যবহার করার প্রমাণ রয়েছে। উনিশ শতক এবং আধুনিক রসায়ন আবিষ্কারের পূর্বে আতশবাজি ছিল তুলনামূলক নিস্তেজ এবং মৃদু। ১৭৮৬ সালে বার্থোলেট আবিষ্কার করে যে পটাসিয়াম ক্লোরেটের সাথে জারণের ফলে বেগুনী রঙ তৈরি করা সম্ভব। পরবর্তীতে আবিষ্কৃত হয় যে বেরিয়াম, স্ট্রন্টিয়াম, তামা এবং সোডিয়ামের ক্লোরেটের সাথে জারণগুলির ফলেও উজ্জ্বল বর্ণ বিশিষ্ট ফুলকি সৃষ্টি হয়।পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আরও একটি উৎসব অনুষঙ্গ আতশবাজি। একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬.৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩.৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩.৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ও ৬.২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আতশবাজিতে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের অনুপাত আরও বেশি। এতে যে শুধু পরিবেশই দূষিত হয় তা নয়; আতশবাজির উচ্চ শব্দ বিভিন্ন প্রাণির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন বরাবরই নগরকেন্দ্রিক। পশ্চিমা বড় শহরগুলোতে এই রাতের আমেজ বেশি ধরা দেয়। নগর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সেখানে নববর্ষ বরণের নানা আয়োজন করে। আতশবাজি ফোটানো হয়, এর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ও এলাকাও থাকে। আতশবাজির শব্দে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও বৃদ্ধরা। এর মধ্যে যারা হার্টের রোগী, যাদের অ্যাজমা আছে কিংবা যাদের স্ট্রোক হয়েছে তাদের জীবন আতশবাজির শব্দের মুহূর্তে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে বুকে ব্যাথাসহ বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আতশবাজির শব্দে অসুস্থ হয়ে এক শিশুর মৃত্যুর কথা নিশ্চয়ই আমরা অনেকে ভুলিনি।ইংরেজি নববর্ষের রাতে আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে শিশুর মৃত্যু, ফানুসের আগুনে পুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাই হয়ে গেছে, এমন অনেক ঘটনা আছে। ঢাকার মতো ঘনবসতি ও বহুতল শহরে ফানুসের আগুন কী ভয়াবহ, সেটি আমরা দেখেছি। বৈদ্যুতিক তারে ফানুস এসে পড়ার কারণে মেট্রোরেলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দুই ঘণ্টা।
ইতালির রাজধানী রোমে বর্ষবরণে আতশবাজির মাধ্যমে নতুন বছর উদযাপনের পর রাস্তায় শতশত পাখির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বিকট শব্দ শুনে সবাই একসঙ্গে আকাশে উড়েছে। একে-অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। জানালায় গিয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের তারে বিঁধেছে। ভুলে গেলে চলবে না, তারা হার্ট-অ্যাটাকেও মরতে পারে।প্রাণি সুরক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আইওপিএ দাবি করছে, গাছগাছালি অঞ্চলে ব্যাপক হারে আতশবাজির কারণে পাখিদের এই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।
আতশবাজির বিকট শব্দ ও এর উজ্জ্বল আলোর কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়। তাই বছরের অন্যান্য রাতের তুলনায় এই রাতে পাখিদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সম্ভাবনা এক হাজার গুণ বেশি। নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের রাডার এবং পাখির সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি চালিয়েছেন। তারা আতশবাজি ফোটানো এলাকাগুলোর সাথে নীরব বা শান্ত এলাকায় পাখিগুলোর গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন। এতে তারা দেখতে পান, আতশবাজির শব্দ পাখিদের ওপর এক ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। আতশবাজির মুহুর্মুহু শব্দে পাখিরা যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। উৎসবগুলোর এমন আনন্দ যেন অন্যের ভয়, আতঙ্ক ও মৃত্যুর কারণ না হয়ে যায়।
আতশবাজির শব্দের কারণে পাখিদের মধ্যে বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। ফলে খাবারের সন্ধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরির পাশাপাশি পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত হয়। পাখি নগরে যুদ্ধাবস্থা মনে করে নগর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে, তারা আর ফিরতে নাও পারে। তারা আর না ফিরলে প্রাণপ্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। পাখিরা না থাকলে ফুল এবং ফল পরাগায়ন হবে না। এতে উৎপাদন কমে যাবে। পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ নানা ভাবে উপকার করে। পাখির বসবাস উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব সকলের।
আতশবাজির আনন্দ মানুষের জন্য হলেও এটি পাখিদের জন্য এক ভয়াবহ মরণফাঁদ। প্রতি বছর উৎসবে আতশবাজির বিকট শব্দ এবং বিষাক্ত ধোঁয়ায় অসংখ্য পাখির মৃত্যু হয়, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শব্দহীন বা আলোকনির্ভর উৎসব পালনে উৎসাহিত হওয়া। লোকালয় বা বনজঙ্গল থেকে দূরে কোনো নির্দিষ্ট খোলা জায়গায় আতশবাজি ফোটানো যেতে পারে। আতশবাজির ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ যেন অন্য কোনো প্রাণের অকাল মৃত্যুর কারণ না হয়। মাত্রাতিরিক্ত অনুষ্ঠান ও আতশবাজিতে পাখি ভয় পেয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে। উৎসবের নামে এই ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে আনন্দ করা উচিত। পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করার স্বার্থে সবাইকে বিধিনিষেধ মানতে হবে।তাই পাখির প্রতি সকলকে দায়িত্বশীল ও যত্নবান হতে হবে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট






ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ও উপকূলীয় বালুচরের নিচে আছে মিঠাপানির ভান্ডার
শীতে প্রকৃতির রূপ
শীতে গৃহহীনদের দুর্বিষহ জীবন
শীতের সবজি কৃষক ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ
প্রাকৃতিক ভারসাম্য, সৌন্দর্য ও উন্নয়নে পর্বত অপরিহার্য
পরিযায়ী পাখির সুরক্ষা দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব
মানবকল্যাণে মৃত্তিকার গুরুত্ব
প্রতিবন্ধী নাগরিক সমাজের বোঝা নয়
আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস 