শিরোনাম:
পাইকগাছা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

SW News24
শুক্রবার ● ৮ এপ্রিল ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » চৈত্র সংক্রান্তি ও চড়ক পূজা
প্রথম পাতা » মুক্তমত » চৈত্র সংক্রান্তি ও চড়ক পূজা
৪০৮ বার পঠিত
শুক্রবার ● ৮ এপ্রিল ২০২২
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

চৈত্র সংক্রান্তি ও চড়ক পূজা

---প্রকাশ ঘোষ বিধান=

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব চড়ক পূজা। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চৈত্রের শেষ দিনে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী এর উৎসব চলে। সমাজের উচ্চবর্ণের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। তবে নিন্মবর্ণের সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

‘সংক্রান্তি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো সূর্য বা গ্রহাদির এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন, সঞ্চার ব্যাপ্তি। চৈত্র মাসের শেষ দিন হলো চৈত্র সংক্রান্তি । ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে সারা পৃথিবী নতুন সাজে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। গাছে গাছে কিশলয় দুলে ওঠে, শাখায় শাখায় ফুল ফোটে আর গাছের ডালে কোকিলের গান। ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহের পরেই প্রকৃতি রুক্ষভাব ধারণ করে, প্রচ- খরতাপ আর বৃষ্টি না হওয়ায জলের অভাব  দেখা দেয়, প্রাণিকুল জলতেষ্টায় ভুগতে থাকে। আর মানুষ বসন্ত বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে যা কালক্রমে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে পরিণত হয়েছে। আর পরের দিনই নতুন বছরের প্রথম দিন হওয়ায় চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবও বেশ গুরুত্ব বহন করে। চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে বিগত বছরকে বিদায় দিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনে সকলকে শুভেচ্ছা জানানো হয় নতুন বছরের,সকলের মঙ্গল কামনা করা হয় ।

সাধারণত বঙ্গাব্দের দিনপঞ্জি মাস গণনার শেষ দিনটিকে সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে। তাই চৈত্র মাসের শেষ দিনটি হলো চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা মাস গণনার ক্ষেত্রে চৈত্র মাস বছরের শেষ মাস এবং চৈত্র সংক্রান্তি বছরের শেষ দিন ।এ কারনে অন্যসব দিনের চেয়ে এদিনের গুরুত্ব অনেকটাই বেশি। প্রাচীনকাল থেকে সাধারণ জনগণ যারা কৃষি কাজ করত তারাই চৈত্র সংক্রান্তিতে নানাবিধ পূজা-পার্বণ, মেলা, লোকাচারসহ উৎসব পালন করত, সে বিবেচনা করলে এটি লোকউৎসব। সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ বিশেষ উৎসব হিসেবে এটি পালন করে থাকে এবং উপবাস, ব্রতাচার, দান ও স্নান পুণ্যলাভের জন্য পালন করে থাকে যেমন, চড়ক, গাজন, উপবাস, ভিক্ষান্ন ভোজন প্রভৃতি। গাজন মূলত কৃষকদের পালা গানের উৎসব। চৈত্রের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির জন্য চাষীরা পালার আয়োজন করে থাকে যা গাজন নামে পরিচিত।

চৈত্রসংক্রান্তির দিন হিন্দুবাড়িতে নীল পূজা উদযাপনের রীতি রয়েছে। নীল পূজা উদযাপনের এই আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি চলে সপ্তাহব্যাপী। শিব ও গৌরী সেজে দল বেঁধে অর্থ সংগ্রহ করেন হাটবাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে। চড়ক উৎসবের উদ্যোক্তারা কয়েক জনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ান। দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখীসহ কয়েক জনের একটি দল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢাক-ঢোলসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পালা গান গায় আর নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা “চড়ক সংক্রান্তির মেলা” নামে অভিহিত। চড়ক চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে পালিত হয়। আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারীদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত। ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পুজোর বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুড়ির ওপর লাফানো, খেজুর মাথায় চড়ে খেজুর পাড়া, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং হাজারা পূজা করা। সাধারণত পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেতে ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এই উৎসবে বহু প্রকারের শারীরিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনও কখনও বা জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এখনও গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই অমানুষিক রীতি প্রচলিত আছে।

লোকউৎসব হিসেবে চড়ক বেশ পরিচিত। এটি চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটি আবার শৈব অনুষ্ঠান হিসেবেও পরিচিত। চড়ক উপলক্ষে যে আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে তা অনেক এলাকায় গাজন, গম্ভীরাপূজা বা নীলপূজা নামে পরিচিত। গবেষকগণের মতে এটি সাধারণত স্থান, অনুষ্ঠানের ধরন ও কালের কারণেই এমন আলাদা আলাদা নাম ধারণ করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মালদহ বা মুর্শিদাবাদে যে আচার-প্রথার মাধ্যমে চড়ক পালিত হতে দেখা যায় তাতে এটি স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, এসব চড়ক পূজারই বিভিন্ন রূপ। আবার শৈব অনুষ্ঠান বলারও কারণ জানা যায়। লোকমাধ্যমে কথিত আছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বাণরাজা যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই বাণরাজা ছিলেন একজন শিব ভক্ত। শিব উপাসক-ভক্ত এই বাণরাজা যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ভগবানের নিকট অমরত্ব লাভের প্রার্থনা জানায়। কিন্তু তাঁর প্রার্থনা জানানোর প্রক্রিয়া ছিল আলাদা। তিনি শিবভক্তিসূচক গীত অভিনয় আকারে উপস্থাপন করে তাঁর আর্জি জানায় এবং অবশেষে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এই কারণেই যারা শিব ভক্ত বা যারা শৈব সম্প্রদায়ের তারা এই উৎসব পালন করে থাকেন। তাই এটিকে শৈব অনুষ্ঠান বলা হয়।

যদিও শিবের আরাধনাই উৎসব পালনের প্রধান উদ্দেশ্য তারপরও এতে আরও দুই দেবতার প্রসঙ্গ এসে যায়। একজন নীলপরমেশ্বরী আর অন্যজন কালাকরুদ্র। নীলপরমেশ্বরীর আরেক নাম নীলচন্দ্রিকা। সাধারণ জনগণ একে নীলাবতী বা নীল নামেও ডাকে। কোনো কোনো এলাকায় নীল এবং গম্ভীর এই দুইটি যেহেতু শিবেরই অন্য নাম তাই এই দুই পুরুষ দেবতার নামে পূজাচার পালিত হতে দেখা যায়। সাধারণত কালাকরুদ্র নামক দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়া হয়ে থাকে। নীলপূজা উপলক্ষে গ্রামের বাইরে ঠিক শ্মশানের ঘাটে হাজরা ঠাকুর বা দানো বারণো নামে আরও এক দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন হয় নীলপূজা আর পরের দিন হয় চড়ক পূজা। সংস্কৃতির বহুউৎপত্তিবাদ তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও এধরনের কিছু উৎসব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। ইউরোপে প্রচলিত মেপাল উৎসব অনেকটা চড়কের মতোই। শ্রীলঙ্কায় প্রচলিত টুককুম উৎসবও চড়কের মতোই। লাদাখ, সিকিম এবং ভুটানের বৌদ্ধদের চোড়গ উৎসবের সঙ্গে চড়ক পূজার মিল পাওয়া যায়। অনেক গবেষক পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে এই চড়ক পূজার প্রচলন বলে মনে করেছেন কিন্তু ভারতীয় উপহাদেশের চড়ক পূজার নৃতাত্ত্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এতে এমন কিছু উপাদান আছে যেগুলি আর্যপূর্ব সভ্যতার চিহ্ন বহন করে।

ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, ‘সামাজিক জলতত্ত্বের দৃষ্টিতে ধর্ম ও চড়ক পূজা দুই-ই আদিম কোম সমাজের ভূতবাদ ও পুনর্জন্মবাদ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত; প্রত্যেক কোমের মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জন্মের কামনাতেই এই পূজার বার্ষিক অনুষ্ঠান।’ তবে বড়শি কিংবা বাণ সন্ন্যাসের মাধ্যমে নরবলি প্রথার চিহ্ন আছে বলেও অনেকে মনে করে থাকেন।

জীবনচর্যা ও মানসচর্চার সামগ্রিক অভিব্যক্তি বিবেচনায় নিলে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বিষয়াদির উপাদানগত প্রমাণাদি দ্বারা বোঝা যায় যে, জীবের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গেও চৈত্র সংক্রান্তির যোগ আছে। প্রচলিত আছে যে, চৌদ্দ রকমের শাক তুলে তবে তা রান্না করা চৈত্র সংক্রান্তির প্রচলিত খাদ্যাচারের অন্যতম। শাকতোলা ও রান্নার ক্ষেত্রে ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটি প্রতীকী বলে ধারণা করা হয় কারণ চৌদ্দ সংখ্যা দ্বারা এই খাদ্যাচারে পরিমাণে বেশি বোঝায়। তবে বাংলার সাধারণ কৃষিজীবী সমাজে ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় যে, চৈত্র মাসে পাওয়া যায় এমন শাকগুলির মধ্যে হেলেঞ্চা, গিমা, পিপুল, কস্তুরি, দন্ডকলম, থানকুনি, তেলাকুচা, খেতাফাটা, কচুশাক, পাটশাক, ঢেঁকিশাক, বথুয়া, শুশ্নি, নুনিয়া, খুইরাকাটা, কারকুল, হাগড়া, কলমি, নেটাপেটা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ঘুম থেকে উঠেই খৈ, চিড়া, মুড়ি-মুড়কি, ঘরে পাতা দই, তিলের নাড়ু, ছাতুর নাড়ু, নারিকেলের নাড়ু প্রভৃতি শুকনো খাবার সকলে মিলে বেশ আনন্দসহ উপভোগ করে থাকে।

সনাতন ধর্ম পালনকারীগণ চৈত্র সংক্রান্তিতে নানা লোকাচার পালন করে থাকেন। মুসলমানরা মেলায় যোগ দেয় উৎসবের আমেজে। মেঘ, বৃষ্টি, জল কামনায় কৃষিজীবীরা আচার-ক্রিয়া পালন করে, ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করে, সমাজের একটি অংশ শিবের গাজন উপভোগ করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তাগুলি বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজুর মতো উৎসবগুলি চৈত্র সংক্রান্তিতে পালন করা হয়।তাই, চৈত্র সংক্রান্তি একান্ত কৃষিজীবীর উৎসব হলেও আজ সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের কারণেই ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলে পালন করে থাকে যা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে সংস্কৃতি বিশ্লেষকগণ মনে করেন।

বাংলাদেশের নানা স্থানে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। মেলায় সকল ধরনের পণ্যই বিক্রি হয়ে থাকে। মেলায় কাঠের তৈজসপত্র, মাটির তৈরি নানা জিনিসপত্র, খেলনা, কাঁসা পিতলের বাসন-কোসন, পূজার নৈবেদ্য আর মিষ্টান্ন বিক্রি হয় দেদারসে। তবে সাধারণত খাবার জিনিসই বেশি বিক্রি হয়। রূপসজ্জার জিনিসও বিক্রি হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা চলতে থাকে মহাসমারোহে। এই চড়ক পূজার ঢোলের বাদ্যে গোটা অঞ্চল আন্দোলিত হত। মেলায় আগমন ঘটে নারীপুরুষ সকল সম্প্রদায়ের লোকের। চড়ক যদিও নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান, কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তির যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তাতে বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

লেখক:সাংবাদিক





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)