

রবিবার ● ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ওজোন স্তর গঠন ও তার গুরুত্ব
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ওজোন স্তর গঠন ও তার গুরুত্ব
প্রকাশ ঘোষ বিধান
আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস। প্রতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে পালিত একটি সচেতনতা দিবস। ওজোন স্তরের ক্ষয় ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরিতে দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোনস্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। এই দিনের স্মরণে ১৯৯৪ সালে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীর জীবকূলকে রক্ষা করে। ওজোন স্তরের ক্ষয়ের ফলে মানবজীবন এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। দিবসটি পালনের মাধ্যমে ওজোন স্তরকে রক্ষা করার জন্য মন্ট্রিল প্রোটোকলের আন্তর্জাতিক চুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।
পৃথিবীর জন্মের সময় ওজোন স্তর ছিল না। তখন প্রাণ সীমাবদ্ধ ছিল সমুদ্রের গভীরে, যেখানে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি অতটা পৌঁছাতে পারত না। পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। আর ওজোন স্তর তৈরি হয়েছে প্রায় দুইশ কোটি বছর আগে, মানে পৃথিবীর জন্মের প্রায় ২৫০ কোটি বছর পর। সে সময় একধরনের জলজ ব্যাকটেরিয়া ছিল। সায়ানোব্যাকটেরিয়া একধরনের আদিকোষ বা প্রাককেন্দ্রীক কোষবিশিষ্ট প্রাণ। এই সায়ানোব্যাকটেরিয়াগুলোই একমাত্র আদিকোষবিশিষ্ট প্রাণ, যারা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য সরাসরি তৈরি কর। এদের কোষের বাইরের দিকে যে আবরণ থাকে, সেই আবরণের ভাঁজে ভাঁজে এই সালোকসংশ্লেষণ ঘটে।
সালোকসংশ্লেষণ মানে, সূর্যের আলো, কার্বন ডাই-অক্সাইড আর পানি ব্যবহার করে উদ্ভিদের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া। এ সময় বিক্রিয়ার বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত, মানে বাড়তি হিসেবে অক্সিজেন তৈরি হয়। সায়ানোব্যাকটেরিয়ার দল সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে যে অক্সিজেন ছাড়ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল বায়ুমণ্ডলে। এভাবে জমতে জমতে আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন জমে যায়। যথেষ্ট পরিমাণ মানে আজকের অক্সিজেনের পরিমাণের তুলনায় ১০ শতাংশের মতো। এ সময়টাকে বলা হয় প্রাক-ক্যামব্রিয়ান যুগ। এর প্রায় ১৫ কোটি বছর পর প্রথম মাটিতে উদ্ভিদ জন্ম নেয়। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় আরও বেশি করে অক্সিজেন ছাড়তে থাকে তারা, ফলে ধীরে ধীরে পৃথিবী আরও প্রাণবান্ধব হয়ে ওঠে।
বায়ুমণ্ডলের অনেকগুলো স্তর আছে। একদম নিচের স্তরটাকে বলে ট্রপোস্ফিয়ার, তার ওপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, আরও ওপরে মেসোস্ফিয়ার ইত্যাদি। ওজন স্তর তিনটি অক্সিজেন পরমাণু নিয়ে গঠিত একটি গ্যাস, যার রাসায়নিক সংকেত O₃। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরের একটি অংশের নাম ওজোন স্তর। আকাশের নীলাভ রং-ই হচ্ছে ওজোন স্তর। ওজোন অক্সিজেনের একটি রূপ। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি এই ওজোন স্তর শোষণ করে নেয়। এর জন্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব থেকে পৃথিবীর উদ্ভিদসহ প্রাণিজগতের বেঁচে থাকা সম্ভব হয়।
ওজন স্তর হলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অংশে অবস্থিত একটি পাতলা গ্যাসীয় স্তর, যেখানে ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব বেশি। এই স্তরটি সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি বিকিরণ শোষণ করে পৃথিবীকে রক্ষা করে, যা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক। মানুষ ও অন্যান্য জীবের জন্য এই স্তরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। ভূপৃষ্ঠের ১০-৫০ কিলোমিটারের অংশটার নামই স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। ওজোন স্তরটি পৃথিবীর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডলের মধ্যে প্রায় ১৫-৩৫ কিলোমিটার ওপরের অংশটা জুড়ে রয়েছে। এখানে ওজোনের ঘনত্ব অনেক বেশি। সে জন্যই এ অংশটাকে বলা হয় ওজোন স্তর। এই স্তরটি সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি (UV) রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীর জীবজগৎকে রক্ষা করে, অনেকটা একটি অদৃশ্য ঢালের মতো কাজ করে।
সূর্য থেকে আলো আসে, পাশাপাশি সূর্য থেকে অতিবেগুনি রশ্মিও বিকিরিত হয়। এই অতিবেগুনি রশ্মিকে ইংরেজিতে আল্ট্রাভায়োলেট, সংক্ষেপে ইউভি বলে। ইউভি তিন ধরনের হতে পারে। ইউভি-এ, ইউভি-বি এবং ইউভি-সি। ইউভি-এ রশ্মির শক্তি সবচেয়ে কম, ইউভি-বির শক্তি মাঝামাঝি আর ইউভি-সির শক্তি সবচেয়ে বেশি। এই সবচেয়ে বেশি শক্তির অতিবেগুনি রশ্মির বেশির ভাগটাই শুষে নেয় ওজোন স্তর। তবে বাকি দুই ধরনের অতিবেগুনি রশ্মি এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে পারে। এর মধ্যে ইউভি-এ রশ্মির পরিমাণ থাকে প্রায় ৯৫%, আর ইউভি-বির পরিমাণ থাকে ৫ শতাংশের মতো। এই স্তরের মূল কাজ হলো সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে নেওয়া। অতিবেগুনি রশ্মি শোষণের ফলে এই স্তরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা বায়ুমণ্ডলের সামগ্রিক তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ওজোনস্তরে ওজোনের ঘনত্ব খুবই কম হলেও জীবনের জন্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি এটি শোষণ করে নেয়। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর মধ্যম মাত্রার শতকরা ৯৭-৯৯ অংশই শোষণ করে নেয়, যা কিনা ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানরত উদ্ভাসিত জীবনসমূহের সমূহ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম। মধ্যম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সূর্যের এই অতিবেগুণী রশ্মি মানব দেহের ত্বক এমনকি হাড়ের ক্যান্সার সহ অন্যান্য মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টিতে সমর্থ। এই ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীর জীবজগতের সকল প্রাণের প্রতি তীব্র হুমকি স্বরূপ। বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর প্রতিনিয়তই এই মারাত্নক ক্ষতিকর অতিবেগুণী রশ্নিগুলোকে প্রতিহত করে পৃথিবীর প্রাণিকুলকে রক্ষা করছে।
পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার পেছনে এই ওজোন স্তরের ভূমিকা অপরিসীম। অতিবেগুনি রশ্মি জীবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, যা ত্বকের ক্যান্সার, চোখের সমস্যা এবং অন্যান্য রোগ সৃষ্টি করতে পারে। ওজোন স্তর এই রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে, যার ফলে জীবজগৎ রক্ষা পায়। কিছু রাসায়নিক যৌগ যেমন ক্লোরোফ্লুরোকার্বন এবং অন্যান্য ওজোন-ক্ষয়কারী পদার্থ বায়ুমণ্ডলে নির্গত হলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়। এই ক্ষয়কারী পদার্থগুলো ওজোন অণুকে ভেঙে দেয়, যার ফলে ওজোন স্তরের ঘনত্ব কমে যায় এবং ওজোন গহ্বর সৃষ্টি হয়, তাকে ওজোন হোল বলে। বিজ্ঞানী ফারম্যান ওজোন স্তরের অবক্ষয় কে ওজোন হোল নামে চিহ্নিত করেন।
প্রতিনিয়ত ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি) গ্যাসসহ অন্য ওজোন স্তর ক্ষয়কারী গ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে ওজোন স্তর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। ভূপৃষ্ঠ এতটাই উত্তপ্ত হচ্ছে যে, সামগ্রিকভাবে বদলে গেছে আবহাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশ।
ওজোন স্তর রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি), বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হ্যালোজেনেটেড হাইড্রো কার্বন, মিথাইল ব্রোমাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইডের মতো ক্ষতিকারক গ্যাসগুলোর ব্যবহার রোধ করা। রাসায়নিক সার তৈরির সময় বেশ কয়েকটি গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয়। সেজন্য কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো এবং জৈব পদার্থের ব্যবহার বাড়ানো উচিত।
পৃথিবীতে আজ সর্বত্রই প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে, দৃশ্যমান হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী রেখে যেতে হলে ওজোন স্তর রক্ষায় শিল্পোন্নত দেশসমূহকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে ওজোন স্তর রক্ষায় ও সামগ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট