

বৃহস্পতিবার ● ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সুন্দরবনের উপকূলীয় নদীতীরে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে মাডস্কিপার উভচর মাছের বিচরণ
সুন্দরবনের উপকূলীয় নদীতীরে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে মাডস্কিপার উভচর মাছের বিচরণ
সুন্দরবনের চর এবং খালের কাছাকাছি অদ্ভুত এক প্রকার মাছ দেখা যায়। এই মাছগুলো সুন্দরবনের চরে বা কাদায় লাফাতে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে চিড়িং মাছ, ডাকুর মাছ বা ডাকার মাছ। যা আসলে এক ধরনের মাথা-ভাঙা মাছ বা মাডস্কিপার। এই মাছগুলো সাধারণত কাদা বা চরে লাফিয়ে বেড়ায়, যা দেখে মনে হতে পারে যেন মাছগুলো লাফিয়ে চলছে। এরা ডাঙায় উঠে আসতে পারে এবং এদের চোখগুলো মাথার উপরে থাকে, যা এদের চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। এদেরকে প্যাডল স্কিপার বা মাথা-ভাঙা মাছও বলা হয়।
মাডস্কিপার হল একটি ছোট মাছ যা তার লেজের ঝাঁকুনি দিয়ে লাফিয়ে উঠতে পারে। এরা মাটিতে হাঁটে এবং বাতাসে শ্বাস নেয়। এটি একটি উভচর মাছ। এই মাছেরা তাদের বক্ষদেশীয় পাখনার সাহায্যে মাটিতে চলাচল করতে পারে।
সুন্দরবনের মৎস্য প্রজাতিগুলোর মধ্যে এটিকেই দেখা হয় সবচেয়ে ব্যতিক্রমী হিসেবে। প্রজাতিতে মাছ হলেও এর জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে ডাঙায়। জলের বাইরে অবস্থানকালে বায়ুমণ্ডলের থেকে চামড়ার মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে টিকে থাকতে পারে মাডস্কিপার। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের কাছাকাছি চরে বিশেষ করে ভাটার সময় যখন জল কমে যায়, তখন এদের চরে লাফাতে দেখা যায়।
একসময় সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় নদীতীরের কাদায় দেখা যেত প্রচুরসংখ্যক মাডস্কিপার। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সুন্দরবনের নদীগুলোয় উভচর মাছটির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমতে দেখা যাচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণসহ, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, নানাবিধ দূষণ ও নির্বিচারে অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে সুন্দরবন।
মাথা-ভাঙা বা মাডস্কিপার মাছ পানিতে এবং ডাঙায় উভয় জায়গায় শ্বাস নিতে পারে। এরা ডাঙায় উঠে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, যা এদের বেঁচে থাকার একটি বিশেষ কৌশল। এরা ডাঙায় উঠে এসে বিভিন্ন ছোট প্রাণী বা কীট-পতঙ্গ শিকার করে খায়। প্রজননের সময় এরা চরে বাসা তৈরি করে এবং নিজেদের এলাকা রক্ষার জন্য এ ধরনের আচরণ করে।
মাডস্কিপার মূলত জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের মাছ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই মাছটির বিভিন্ন প্রজাতির উপস্থিতি দেখা যায়। বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাইরে এটিকে নাফ নদী ও মহেষখালী বাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে এটি ডাহুক মাছ, ডাকার, ডাকুর বা চিড়িং মাছ নামেও পরিচিত। গবেষকরা জানিয়েছেন, মাডস্কিপার বুকের নিচে থাকা পাখার সাহায্যে মাটিতে চলাচল করতে সক্ষম। জোয়ারের সময় মাছটি পানির নিচে ও ভাটার সময় কাদামাটিতে চলাচল করতে পছন্দ করে।
বাংলাদেশে কয়েক প্রজাতির মাডস্কিপার দেখা যায়। এর মধ্যে একটি হলো সাদা ফোঁটা ডাহুক। এর মাথা ও দেহের রঙ নীল এবং উজ্জ্বল বর্ণের ডোরাকাটা। চোখ থেকে বুক ও পাখার গোড়া পর্যন্ত বাদামি ডোরাকাটা। পৃষ্ঠপাখনা শুরু হয়েছে লাল বর্ণ দিয়ে। বাংলাদেশ ছাড়াও ক্রান্তীয় ও মেরু অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকা, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এবং আটলান্টিকের তীর, ভারত এবং ফিলিপাইনে এদের দেখা যায়। মাডস্কিপারের প্রধান খাবার পানি এবং কাদায় থাকা ছোট কীটপতঙ্গ। বিপদ এলে শক্ত কাদার গর্তে দ্রুত লুকিয়ে পড়ে মাডস্কিপার।
মৎস্য শিকারের বিষ প্রয়োগের কারণেও এদের মৃত্যু হচ্ছে। সুন্দরবনের মতো জায়গাও এখন মাডস্কিপারদের জন্য দ্রুত অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। সুন্দরবনের অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনকেও মাডস্কিপারের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একদিকে পর্যটন নৌযানের তেল নদীতে মিশে বনে দূষণ ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে পর্যটকদের ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য গোটা সুন্দরবেনর প্রাণবৈচিত্র্যকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।