শিরোনাম:
পাইকগাছা, বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫, ৫ ভাদ্র ১৪৩২

SW News24
মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মহাবিপন্ন প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুন
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মহাবিপন্ন প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুন
১৬ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ১৯ আগস্ট ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

মহাবিপন্ন প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুন

--- প্রকাশ ঘোষ বিধান

প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুন আজ মহাবিপন্ন। বিশ্বের জীববৈচিত্রে শকুন একটি খুবই উপকারি পাখি। শকুন মৃত পশু-পাখি খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে এবং রোগজীবাণু ছড়ানো রোধ করে। তারা প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করে এবং মৃতদেহ দ্রুত অপসারণ করে পরিবেশকে রোগমুক্ত রাখতে সহায়তা করে।

শকুন বড় ডানাওয়ালা বৃহদাকার পাখি। যারা তীক্ষ দৃষ্টির অধিকারী শিকারি পাখি । এদের মাথা, ঘাড় ও গলায় কোনো পালক নেই। তবে ঠোঁট খুবই ধারালো। এরা ময়লার ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খায়। অনেক দূর থেকে শকুন মৃতপশুর দেহ দেখতে পায়। এরপর তারা দলবেঁধে সেখানে নেমে এসে দ্রুত সাবাড় করে দেয়। শকুনের পাকস্থলীর জারণ ক্ষমতা অসাধারণ। মৃত পশুর দেহ তো বটেই, এমনকি এসব পশুর হাড় পর্যন্ত এরা হজম করে ফেলতে পারে।

বিশ্বের বহু দেশের সংস্কৃতিতে শকুন নিয়ে নানা মিথ, কুসংস্কার ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শকুন মানেই অমঙ্গল, মৃত্যুর পূর্বাভাস, মৃত্যুদূতও বলা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, শকুন যেখানে ঘোরাফেরা করে, সেখানে কেউ মারা যেতে পারে।

কুসংস্কারের ফাঁদে কথিত অলক্ষুণের তকমা পেয়েছে শকুন। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা কর্মী হয়ে বিষাক্ত বায়ুর থাবা থেকে রক্ষা করছে মানবজাতিকে। ডাইক্লোফেনাক ওষুধে চিকিত্সা করা পশুর মৃতদেহ খেয়েই নির্বিচার প্রাণ হারাতে থাকে শকুন। এই শকুন আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কখনও খাবার না পেয়ে আবার কখনও মানুষের হিংস্রতার শিকার হয়ে।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের (আইইউসিএন) মতে, প্রকৃতি থেকে কোনো প্রাণীর মোট সংখ্যার ৯০ শতাংশই হারিয়ে গেলে সেটা লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী। জরিপ বলছে, ১৯৭০ সালে দেশে শকুনের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো। স্বাধীনতার পর কমতে কমতে ২০১৪ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ২৬০টিতে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জরিপে দেশে ২৬৮টি শকুনের অস্তিত্ব মিলেছে। ফলে আইইউসিএন সংস্থার লাল তালিকাভুক্ত হয়েছে শকুন। বিপর্যয়ে পড়া শকুন সংরক্ষণ এবং বংশবৃদ্ধির তাগিদ থেকে সারাবিশ্বে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে।

প্রায় চার কোটি বছর আগে শকুনের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। গোটা আমেরিকা মহাদেশ নতুন পৃথিবীর শকুন আর আফ্রিকা, ইউরেশিয়া ও এশিয়াতে পুরাতন পৃথিবীর শকুন ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবর্তিত হলেও বিস্ময়করভাবে তাদের জীবনধারা প্রায় একই রকম। নিরীহ প্রাণীটি মৃতদেহ খাওয়ার মাধ্যমে যারা পরিবেশ-প্রকৃতিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখত। ৩-৪ কোটি বছর আগে পুরাতন গোষ্ঠীর বিবর্তন  শুরু হয়েছিল। আর ২ কোটি থেকে আড়াই কোটি বছর আগে থেকে নতুন গোষ্ঠীর অভিযোজন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। যারা বিশ্ব জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছিল।

বিশ্বে মোট ১৮ প্রজাতির এবং বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুন দেখা যেত। যার মধ্যে বাংলা শকুন, কালা শকুন, রাজ শকুন, হিমালয়ী গৃধিনী, সরুঠুঁটি শকুন ছিল উল্লেখযোগ্য। রাজ শকুন তো পুরোপুরিই বিলুপ্ত। দেশে টিকে থাকার মধ্যে বাংলা শকুনই অন্যতম।  শকুনের দুটি প্রজাতি হিমালয়ান ও ইউরেশীয় মূলত পরিযায়ী। এরা শীত মৌসুমে দেশে আসে। এপ্রিল মাস পর্যন্ত অবস্থান করে।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি ভারতে শকুন ছিল ৫ কোটির বেশি। স্বাধীনতার সময়েও দেশে শকুনের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের বেশি। ২০০৯ সালে দেশে শকুন ছিল ১ হাজার ৯৭২টি। মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে প্রায় ১ হাজার ৮০০ শকুন মারা পড়ে মহাবিপন্ন পাখির তকমা পায়। কয়েকশত বাংলা শকুন এখনও বেঁচে আছে। এরাই বাংলাদেশের শেষ শকুন। বাংলাদেশের শেষ শকুনগুলো এখন দেখতে পাই সিলেট ও খুলনা বিভাগে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে আইইউসিএন এর শুমারিতে ২৬৭টি শকুনের অস্তিত্ব মিলেছে। এ শেষ শকুনগুলোও দু-চারটি করে মারা যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে অতিপ্রয়োজনীয় ও অতুলনীয় এ পাখি এখন বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

নব্বইয়ের দশকে গ্রামগঞ্জে প্রচুর শকুন দেখা যেত। কোথাও কোনো মরদেহ পড়ে থাকতে দেখলে মুহূর্তেই খবর যেত শকুনের দলের কাছে। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই মৃত গবাদি পশুর মাংস সাবাড় করে প্রকৃতিকে পরিষ্কার করে ফেলত।

পশু চিকিত্সায়  ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার শুরুর পর তা কমতে শুরু করে। দুই দশকের বেশি আগে থেকে ভারতে অসুস্থ গরুর চিকিত্সায় ব্যাপকহারে সস্তা নন-স্টেরয়েডাল ব্যথানাশক  ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার হতে থাকে। আর এই ওষুধে চিকিত্সা করা পশুর মৃতদেহ খেয়েই নির্বিচার প্রাণ হারাতে থাকে শকুন।

মহাবিপন্ন প্রজাতির পাখি শকুন রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ও আইইউসিএন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ এ শকুনকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফলে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ২০১৬-২০২৫ পর্যন্ত দশকব্যাপী শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যার অংশ হিসেবে সরকার ২০১০ সালে পশু চিকিত্সায় ডাইক্লোফেনাক ও ২০১৭ সালে দুই এলাকায় কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি ২০১৩ সালে জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটিও গঠন করা হয়।

২০১৪ সালে সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ আর খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ মিলে মোট সাড়ে ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা শকুনের জন্য নিরাপদ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া আইইউসিএনের সঙ্গে যৌথ ব্যবস্থাপনায় শকুনের প্রজননকালীন রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও সুন্দরবনে দুটি ফিডিং সেন্টারও স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া অসুস্থ এবং আহত শকুন উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য দিনাজপুরে শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

শবভুক বলে শকুনকে এদেশের মানুষ ঘৃণা করতেই অভ্যস্ত ছিল। সমাজের শোষকদের শকুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কুদৃষ্টিকে  শকুনি দৃষ্টি বলে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু আসলে শকুনের মতো নিরীহ প্রাণী আর হয় না। মৃতদেহ ছাড়া শকুন কিছুই স্পর্শ করে না, জীবিত প্রাণীর কোনো ক্ষতি কখনও সে করে না। শকুনের মতো উপকারী প্রাণী কমই আছে। শকুন প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা বুঝতে পেরেছি, এ পাখি আমাদের পরিবেশের জন্য কত প্রয়োজনীয় ছিল। জনস্বাস্থ্যের জন্য শকুন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখন শকুন বিলুপ্তির বিরূপ প্রভাব অনুভব করছি, তাই শকুন আমাদের চাই। শকুন রক্ষা করার জন্য এখন বাংলাদেশের মানুষও সোচ্চার হচ্ছে।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)