

শনিবার ● ১৬ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » ক্ষুদ্র পতঙ্গ মশার কামড় বিপজ্জনক
ক্ষুদ্র পতঙ্গ মশার কামড় বিপজ্জনক
প্রকাশ ঘোষ বিধান
মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। মশা চিরকালীন বিরক্তিকর একটি নাম, যা শোনার সাথে সাথেই মাথায় আসে কানের কাছে ভনভন করা আর ত্বকের জ্বালাযুক্ত কামড়। মশা এক যন্ত্রণাদায়ক পতঙ্গ। বিরক্তিকর উপদ্রবের পাশাপাশি তারা রোগজীবাণু সংক্রামণ করে। মশা আমাদের জন্য অন্যতম আতঙ্কের নাম।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পৃথিবীতে মশার অস্তিত্ব আছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশার মধ্যে এনোফিলিস, এডিস, কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে পুরোনো রোগ। খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে গ্রিস ও চীনে এ রোগের অস্তিত্ব ছিল।
বিশ্ব মশা দিবস প্রতিবছর ২০শে আগস্ট পালিত একটি দিবস। ২০শে আগস্ট মশা দিবস পালন করা হয় মূলত চিকিৎসক রোনাল্ড রসের আবিষ্কারকে সম্মান জানানোর জন্য। ১৮৯৭ সালের ২০শে আগস্ট চিকিৎসক রোনাল্ড রস অ্যানোফিলিস মশা বাহিত ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৩০-এর দশক থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন দিবসটি প্রথম পালন করা শুরু করে। মশাবাহিত রোগ থেকে সাবধান হওয়ার জন্য, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এবং মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য এ দিবসটি পালন করা হয়।
মশা নিতান্তই ছোট একটি পতঙ্গ অথচ এর মতো জ্বালাতনকারী কীট বিশ্বে বোধহয় আর নেই। মশা এক প্রকারের ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ। মশার দাঁত সংখ্যা ৪৭টি। মশা তার লম্বা প্রোবোসিসের মাধ্যমে মানুষের ত্বকের ভেতর সুঁইয়ের মতো করে প্রবেশ করে এবং রক্ত চুষে নেয়। এই প্রক্রিয়াটিকে কামড় বলা হয়। মশা কামড়ানোর সময় একটি ব্যথানাশক তরলও শরীরে প্রবেশ করায়, ফলে কামড়ানোর সময় তেমন অনুভূতি হয় না। অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রীমশা স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্ত পান করে থাকে। কিছু মশা রোগজীবাণু সংক্রামক। যেসব মশা নিয়মিত মানুষকে কামড়ায় তারা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের শরীরে রোগজীবাণু সংক্রমণের চলক হিসেবে কাজ করে। মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাস ও অন্যন্য প্রাণঘাতী রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। সংক্রমিত রোগের জন্য দায়ী এই মশাই।
মশার কামড়ে শুধু যে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া হয় তা নয়, বরং মশা বিভিন্ন রোগের বাহক হিসেবেও কাজ করে। মশা সাধারণত গ্রীষ্মপ্রধান এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় বেশি দেখা যায়। মশা এক ধরনের ক্ষুদ্র পোকা, যা মানুষের রক্ত চুষে বেঁচে থাকে। স্ত্রী মশাই মূলত রক্ত খেয়ে থাকে, পুরুষ মশা ফুলের রস দিয়ে জীবিত থাকে। মশা কিন্তু রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে না। মূলত রক্তের প্রোটিন অংশটি কাজে লাগিয়ে তারা ডিম পাড়ে। তাইতো পুরুষ মশা কখনো হুল ফোটায় না।
পৃথিবীর প্রায় ৩,৫০০ প্রজাতির মশা রয়েছে, যা বিভিন্ন অঞ্চলে বিচরণ করে। একটি পুরুষ মশা গড়ে ১ থেকে ২০ দিন এবং স্ত্রী মশা ৩ থেকে ১০০ দিন পর্যন্ত বাঁচে। নারী মশা সচরাচর ৬-৮ সপ্তাহ বেঁচে থাকে। আর পুরুষ মশা একদিনের বেশি বাঁচলেও তাদের পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক হয়ে পড়ে। এই ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ দীর্ঘ ২৫০০ বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীতে মশার সংখ্যা এত বেশি যে কোনোদিনই মশা সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়। আর মানুষের সব ধরনের মশা নির্মূলের প্রয়োজনও নেই। এডিস, অ্যানোফিলিস এবং কিউলেক্স মশাই মূলত মানুষের শত্রু।
মশাকে যতই তুচ্ছ ও অবহেলা করা হোক না কেন, জীবাণু সংক্রমণকারী এই মশাই পৃথিবীতে সবচেয়ে জীবনঘাতী পতঙ্গ। মশা এমনিতে ক্ষুদ্র হলেও এর প্রভাব মোটেও ছোট নয়। মশার কামড় আমাদের জীবনকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হওয়ার কারণে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেই দিক থেকে এটা পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধবাজ দেশ, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। প্রতিবছর এ ক্ষুদ্র জীবটি লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে। ম্যালেরিয়া ছাড়াও ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল, ইয়োলো ফিভার ইত্যাদি রোগ মশা ছড়ায়। কাজেই মশাকে ক্ষুদ্র করে দেখার সুযোগ নেই।
পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব মশার শতকরা মাত্র ৬ ভাগ হলো স্ত্রী-মশা এবং এরাই মানুষকে কামড়ায়, মানুষের রক্ত খায়। এই ৬ ভাগের অর্ধেক, অর্থাৎ মাত্র শতকরা ৩ ভাগ মশা মানুষের শরীরে রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই ৩ ভাগ মশা মেরে সাফ করতে পারলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
মশাবাহিত ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশার কামড় এড়ানো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মশারোধী স্প্রে ব্যবহার করা। বাড়ির আশেপাশে যেকোনো ছোট পাত্রে স্থায়ী পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করা। মশার কামড় হতে পারে প্রাণঘাতী। তাই সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই হতে পারে সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট