শিরোনাম:
পাইকগাছা, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২

SW News24
মঙ্গলবার ● ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শীতে প্রকৃতির রূপ
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শীতে প্রকৃতির রূপ
৩০ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

শীতে প্রকৃতির রূপ

--- প্রকাশ ঘোষ বিধান

শীতকাল বাংলার প্রকৃতিতে এক অনন্য ও শান্ত রূপ নিয়ে আসে। শীতকাল প্রকৃতিকে একদিকে যেমন বিবর্ণ করে তোলে, তেমনি প্রকৃতির বুকে নিয়ে আসে এক অন্যরকম সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতা। শীত আসে শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়।

আমাদের দেশে প্রাচীন প্রবাদ প্রচলন আছে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ শক্তিশালী প্রাণিটিও মাঘের শীতের হাত থেকে রেহায় পায় না। ষড় ঋতুতে শীতের আগমন বৈচিত্রময়। আমাদের দেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুচক্রে ৬টি ঋতুতে ভাগ হয়েছে। প্রকৃতি আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাবে বছরের ১২টি মাস ২ মাস করে ৬ ঋতুতে ভাগ হয়েছে। এই ৬টি ঋতু হলো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত শীত ও বসন্ত। তবে সব ঋতুর প্রাধান্য ও প্রভাব এক নয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত প্রত্যক্ষ আর শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত পরোক্ষভাবে প্রকৃতিতে প্রতিফলিত হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত এ তিনটি ঋতু প্রকৃতি উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জনজীবনে প্রচন্ড নাড়া দেয়। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত জনজীবনে অনুভুত হয় যেন তার আগমন নিরব নিভৃতে। ঋতুচক্রে বৈশাখ-জৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল, আষাড়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্মিন শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রায়ন হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল ও ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল। গ্রীষ্ম, বর্ষার পর আসে শরৎ কিছুটা পরে তা মিশে যায় হেমন্তে। শীতের অবস্থান হেমন্তের পরে ও বসন্তের আগে। শীতকাল পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস হলেও এর শুরু কিছুটা আগে এবং শেষ হয় কিছুটা পরে। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্য ৫টি ঋতু থেকে শীত ঋতুর বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। পৌষ-মাঘ এই ২ মাস নিয়েই শীতকাল। শুষ্ক চেহারা আর হীমশীতল অনুভব নিয়ে আসে শীত ঋতু। এ সময় গ্রাম বাংলা শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোর বেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হীমেল হাওয়ায় হাঁড় কাপিয়ে শীত জেকে বসে। প্রকৃতি শীতের দাপটে নির্জীব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মুর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে। শীত তার চরম শুষ্কতার রুপ নিয়ে প্রকৃতির উপর জেকে বসে। রুক্ষতা, তীক্ততা ও বিষদের প্রতিমুর্তি হয়ে শীত আসে। শীতের তান্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে পড়ে।

শীতের সকাল থাকে কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কখনও কখনও কুয়াশার স্তর এত ঘন থাকে যে, সামনের সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনেক দেরি করে উঠা সুর্যের আলো নির্মলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যেন তাতে কোন তেজ নেই। পুকুরের পানি মনে হয় বরফের মত জমে আছে। আর তার উপর থেকে হালকা ধোয়া উড়তে দেখা যায়। ভোর রাত থেকে গাছের পাতায় পড়া শিশির বড় বড় ফোটায় বৃষ্টির মত ঝরতে থাকে। সকালে মাঠে মাঠে ঘাসের ডোগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশিরে রোদের আলোয় ঝিকমিক করে। ধানের ক্ষেত শাক সবজির উপর টলমল করা শিশির বিন্দু সূর্যের সোনালী রশ্মিতে মুক্তর মত ঝলমল করে। এ সময় গ্রামের ক্ষেতে-ক্ষেতে ধান কাটা শুরু হয়। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। শীতে এ সময় শহর -গ্রামের সবখানে চলে নবান্ন উৎসব। শীতের সকালে খেজুরের মিষ্টি রস সবার মন কাড়ে। গাছিরা কলস ভরে রস নিয়ে আসে। খেঁজুর রসের পায়েস আর নলেন গুড়ের কথা ভাবলে জিহব্বায় জল এসে যায়। শীতকালে সর্বত্র নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। গ্রামে গ্রামে রং বেরঙের পিঠা, ক্ষীর, পায়েস খাওয়ার ধুম। বাড়ি বাড়ি পিঠা পুলি তৈরি হয়। রসের পিঠা, তেলে পিঠা, পাটি শাপটা, ভাপা পিঠাসহ বিভিন্ন সাচে তৈরি নানা রকমের পিঠা। যা দেখলে সকলের মন কাড়ে। এ সময় বিভিন্ন সংগঠন থেকে শুরু হয় রকমারী পিঠা উৎসব। বাড়ি বাড়ি ছাড়াও সন্ধ্যায় হাট বাজারের আতপ চালের গুড়ো, গুড় ও নারিকেল কোরা দিয়ে তৈরি গরম পাটিসাপটা খেতে ভারী মজা। অন্যকে খেতে দেখলে নিজের অজান্তেই জিহবক্ষায় পানি এসে যাবে।

শীতকালে পাকা ধানের সোনালী খেতের দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যায় না। পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার পর পরই কৃষকরা আবার বোরো আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কৃষক নাঙ্গল, জোয়াল কাঁধে গরু নিয়ে মাঠে চলে। সারা দিনই কৃষক চাষাবাদে ব্যস্ত সময় পার করে। শীতকালের শাক সবজিতে খেত ভরে যায়। লালশাক, পালনশাক, শীম, বরবটি, লাউ, টমেটো, গাজর, শালগম, মুলাসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি শোভাবর্ধন করে। যা আমাদের খাবার হিসাবে আকৃষ্ট করে। সরিষা ফুলের হলুদ ক্ষেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্যতে দৃষ্টি যেন আটকে যায়। আর শীতকালের রং বেরঙের ফুল গাদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ প্রভৃতি শোভাবর্ধন করে। ফুলের দোকানগুলো বাহারী ফুলে ভরে যায়।

গ্রাম এলাকার শীতের সকাল ও বিকাল বড়ই চমৎকার। শীতের দীর্ঘ রজনী কম্বল, লেপ, কাথা মুড়ি দিয়ে জড়ো সড়ো হয়ে রাত কাটে। সকালে উঠে সূর্য উঠা অপেক্ষায় সবাই উশখুশ করতে থাকে। চায়ের দোকান গুলোতে চা পানের ধুম পড়ে যায়। সকালের মিষ্টি রোদে ছেলে-মেয়েরা চিড়া-মুড়ি, খেঁজুরের পাটালি গুড় খেতে খেতে রোদ পোহাতে থাকে। শীতের দিনের বেলা ছোট হওয়ায় বেলা মাথার উপর আসতে আসতে যেন সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ সময় শীতের দাপট থেকে বাচতে সবাই শীতবস্ত জ্যাকেট, জাম্পার, ছুয়েটার, মাফলার, কোট সহ রং বেরঙের বাহারি পোশাক পরিধান করে। সাজ পোশাকে আসে নানা বৈচিত্র। বাহারি এসব পোশাক দেখে চোখ জুড়ায়। শীতের প্রকৃতি যেন ঝিমিয়ে পড়ে। শীতের শুষ্কতায় প্রকৃতি বিবর্ণ রুক্ষ মুর্তি ধারণ করে। হাড় কাপানো শীতের দাপটে অনেক অস্বস্তির অনুভূতির মধ্যে একটি হলো ঠোট ও পা ফেটে যাওয়া। শীত থেকে রক্ষা পেতে নানা প্রসাধনীর কদর বেড়ে যায়।

শীতকালে অতিথি পাখির আগমন এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। পাখিরা বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে এসে আমাদের দেশের হাওড় বাওড় ও জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। নানা রং বেরঙের পাখি দেখে মন ভরে যায় আর কলকাকুলিতে এলাকা মুখরিত হয়। শীতের অনুকুল আবহাওয়ায় দেশী-বিদেশী ভ্রমন বিলাসী পর্যটকের আগমন ঘটে। বিদেশী পর্যটকদের আগমনে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেড়ে যায়। এতে অর্থনৈতিক খাত সমৃদ্ধ হয়। দেশের দর্শনীয় স্থান ও পিকনিক স্পটগুলোতে ভ্রমনকারীদের ঢল নামে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে শিক্ষা সফর শুরু হয়। তাছাড়া গ্রামের হাট বাজার উন্মুক্ত স্থানসহ সর্বত্র পিকনিকের আয়োজন বেড়ে যায়।

গ্রামের শীতের সকাল কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। শীতের মধ্যে মাঝে মাঝে শুরু হয় শৈত প্রবাহ। আর এ সময় তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে যায়। হাড় কাপানো শীতে মানুষ, জীবযন্তুর সাথে সাথে প্রকৃতি যেন অসাড় হয়ে পড়ে। শীতের হাত থেকে বাচতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। শীতবস্ত্র কেনার ধুম পড়ে যায়। যে যার সাধ্যমত গরম কাপড় ক্রয় করে নিজেকে শীত থেকে সুরক্ষা করার চেষ্টা করে। শীতের সকাল ও রাতে ছিন্নমুল জনগোষ্টী আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে। ভবোঘুরেরা হাট বাজার স্কুল কলেজের বারান্দায় আশ্রয় খোজে। শীতে বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা শীত জনিত জ্বর, সর্দিকাশি, নিউমোনিয়া, ডাইরিয়াসহ বিভিন্ন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। শীত নিুবৃত্ত ও গরীব মানুষের জীবনে দুর্যোগ হয়ে দেখা দেয়। তারা এ সময় অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করে।

কবি সুকান্তের ভাষায়-
সূর্য
তুমি আমাদের স্যাঁত স্যাঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।

শীত আমাদের জীবনে যেমন সুখ-শান্তি বয়ে আনে, তেমনি দুঃখ-কষ্টও বয়ে আনে। শীত আমাদের জীবনকে করেছে বৈচিত্রময়। কবি সুকান্ত ভট্টচার্যের কাছে শীত দুঃখের বার্তা নিয়ে এসেছে। দরিদ্র মানুষের কাছে শীতের ভয়াবহতা কবিকে চিন্তিত করেছে। তাই নিুবর্গের মানুষের জন্য সূর্যের কাছে তার প্রার্থনা, সূর্য যেন শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের উত্তাপ দেয়।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)