শিরোনাম:
পাইকগাছা, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

SW News24
বুধবার ● ২৩ আগস্ট ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » হলুদ সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য
প্রথম পাতা » মুক্তমত » হলুদ সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য
৩৮৩ বার পঠিত
বুধবার ● ২৩ আগস্ট ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

হলুদ সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য

 

 প্রকাশ ঘোষ বিধান

ঊনবিংশ শতাব্দীতে হলুদ সাংবাদিকতার সূত্রপাত। জসেফ ক্যাম্পবেল হলুদ সাংবাদিকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন গুরুত্বহীন সংবাদ বড় করে দেওয়া, গুজব-গুঞ্জন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে  প্রকাশ করা। তবে ১৮৯৮ সালের স্পেন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের জন্য হলুদ সাংবাদিকতা অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হয়। মার্কিন পত্রিকাগুলো তখন এমন কিছু সংবাদ প্রকাশ করেছিল, যা সত্য নয়। অতিরঞ্জিত ও অসত্য। এসব খবর দুই পক্ষকেই উত্তেজিত করে যুদ্ধে আক্রমণের জন্য। এরই ফাঁকে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিউ ইয়র্ক শহরের পত্রিকাগুলো সার্কুলেশন বাড়ানোর জন্য এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু করে। শুরুতে প্রচার বাড়ানোর জন্য অশুভ প্রতিযোগিতাকে বলা হয়েছে হলুদ সাংবাদিকতা। তখন অবশ্য চাঁদাবাজি ছিল না। এখন সব অনৈতিক কাজকে হলুদ সাংবাদিকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ক্রমেই এর বিস্তার ঘটছে। এ কারণে মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা এখন বড় ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন। দেশে খুবই স্বল্পসংখ্যক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান পেশাদারি বজায় রেখেছে। এই দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে হলুদ সাংবাদিকতা দিন দিন বাড়ছে।

দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য। আর এইসব সাংবাদিকের ফাঁদে পড়ে হয়রানি শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, সাংবাদিক পরিচয়ে সংবাদ প্রকাশের কথা বলে অর্থ আদায়, দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি, মোটরসাইকেলে প্রেস বা সাংবাদিক লিখে মাদকের ব্যবসাও চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। আর প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে মূলধারার পেশাদার সাংবাদিকরা।

তবে স্থানীয়রা এই ভুয়া সাংবাদিকদের বিষয়ে মুখ খুললেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। কেননা প্রশাসনের কোন কোন কর্তাব্যক্তিরাই দুর্নীতির সাথে জড়িত আছে। প্রশাসনের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে গ্রাম, উপজেলা ও জেলায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এইসব ভুয়া সাংবাদিকরা। আর এতে বিপাকে পড়ছেন পেশাদার সাংবাদিকরা।

স্থানীয় প্রশাসনে ও প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দ হলুদ সাংবাদিকের বিরুদ্বে কোন পদক্ষেপ নেয় না। এতে করে  উপজেলা ও জেলায় হলুদ সাংবাদিকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।একটি উপজেলায় মূলধারার পেশাদার সাংবাদিকের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ জন হতে পারে। তবে বিভিন্ন অনলাইন, ফেইসবুক পেইজ, স্বঘোষিত নামধারী সাংবাদিক পরিচয়দানকারীর সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন পেশাদার সাংবাদিকেরা। এসব হলুদ সাংবাদিকদের কবলে পড়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

  উপজেলা ও জেলায় নামধারী এসব হলুদ সাংবাদিক পরিচয়দানকারীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে অনেকেই। সাংবাদিকতার নামে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র। এমনকি পেশাদার সাংবাদিকেরাও এসব প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে নিজেদের ঐতিহ্য, সুনাম ও ব্যক্তিত্ব হারাতে বসেছে।

উপজেলা ও জেলার আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো জেগে উঠছে নামধারী হলুদ সাংবাদিক। যা নিয়ে সচেতন মহল এবং সুশীল সমাজ নানাভাবে সমালোচনা করছেন। সাংবাদিকতার মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন  মূলধারার পেশাদার সাংবাদিকেরা।

 জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন যুবক নিজেদের বিভিন্ন অনলাইন, ফেইজবুক পেইজ, অনিয়মিত ও নামসর্বস্ব (আন্ডারগ্রাউন্ড) পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে রীতিমতো প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ঘোষণা দেয় ফেসবুকে পত্রিকায় চোখ রাখুন,অমুকের তমুকের নামে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে।তবে এসব হুমকির সংবাদ আলোর মুখ দেখে না কোন দিন। বিভিন্ন মাধ্যমে চাঁদা বাজি সহ সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে অপকর্মও করে আসছে। এসব হলুদ সাংবাদিকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করা সহ প্রকাশ্যে দল ও নেতাদের পরিচয় ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে বলেও জানান ভুক্তভোগীরা।

একটি চক্র প্রেস কার্ড গলায় ঝুলিয়ে নিজেদের সাংবাদিক পরিচয়ে সঙ্গবদ্ধভাবে গ্যাং সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি ও মানুষকে জিম্মি করে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে প্রশাসন থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ চরমভাবে বিভ্রান্তিতে পড়ছে। স্থানীয় এসব ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকর্মী বা সাংবাদিক পরিচয়ে একটি চক্র প্রতিনিয়ত প্রেসকার্ড ব্যবহার করে ও গাড়িতে স্টিকার লাগিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। তারা দল বেধে কোন ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিসে গিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিভ্রান্ত ও কাজ হাসিল করছে। এতে সাধারণ মানুষ, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, পেশাদার সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের সচেতন নাগরিকগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। পেশাদার সাংবাদিকদের লেখা প্রকাশিত নিউজ কপি করে  অনলাইন বা নামমাত্র পেইজে নিজের নামে প্রচার করছে। সাংবাদিক পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি, মোবাইল ফোনে হুমকি, অবৈধ ব্যবসা ও বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছে।

মফস্বলে যে সকল সাংবাদিকরা পারিবারিক সচ্ছল তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে ও ভয় দখিয়ে কর্মকান্ড করছে। অনেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতেও সাংবাদিকতা পেশায় এসেছে।তবে যারা গরীব বা অস্বচ্ছল তারা আরও বেশি ভয়ানক। অস্বচ্ছল পরিবারের কোন ছেলে যদি মফস্বলে সাংবাদিকতা করে তাহলে তার সংসারের খরচ যোগাতে সে হলুদ সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ে। অভাব অনাটনে তাকে নীতি নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য করে। আর এ সুযোগে সমাজের অসাধু লোকজন তাদের গরীবি দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নানা অপকর্মে  এসব হলুদ সাংবাদিকদের ব্যবহার করে। এছাড়াও যারা মফস্বলে সখের বশে সাংবাদিকতা করেন, তারা বেশিদিন সাংবাদিকতা পেশায় থাকতে পারেন না। কারণ নিজের পকেটে টাকা থাকলে সাংবাদিকতা টিকে থাকবে। আর টাকা শেষ তো সাংবাদিকতাও  শেষ।

মফস্বলের সাংবাদিকগণ বেশিরভাগই স্থানীয়। পেশাগত কাজের স্বার্থে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের সাথে উঠা-বসা ও সুসম্পর্কের সুবাধে অনেক মফস্বল সাংবাদিকই এলাকায় আদিপত্য বিস্তার করতে চায়। সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে অনেকেই অসৎ কাজ করে থাকেন। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো মফস্বলের অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধেই এলাকায় মাদক বিক্রি বা সহযোগিতার অভিযোগ আছে। অনেকে চাদাবাজি করতে গিয়ে মামলার শিকার হয়েছে।কেউ কেউ হাতে নাতে ধরা খেয়ে জেল খেটে আবার সাংবাদিকতা পেশায় এসেছে এমন নজীরও আছে।

প্রকৃত সাংবাদিকরা ঐক্যজোট না থাকায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন জ্যেষ্ঠ সংবাদিকরা। প্রকৃত সাংবাদিকরা একত্রিত না থাকায় রাজনীতিবিদরা এই সুযোগ নিচ্ছে। দলীয় লোকদের সাংবাদিক বানিয়ে পেশাদার সাংবাদিকদের বিপাকে ফেলানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে রাজনীতিবিদরা। অনেকে বেশ কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠন খুলে পদও দখল করে রেখেছেন। সাংবাদিক পরিচয়কে ব্যবহার করে তারা সুবিধা নিচ্ছেন। আইনের অপ্রতুলতা ও প্রয়োগের ব্যর্থতার কারণে দেশের সাংবাদিকতা ও সংবাদ মাধ্যমগুলোর মান দিনে দিনে নিম্নমুখী হচ্ছে। অনেক সুশীল ও সচেতন পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সংবাদ মাধ্যম থেকে। অন্যদিকে এর প্রভাব পড়ছে আদর্শ সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের উপর। এই অবয়ের কারণেই শ্রেণী বিভক্তি দেখা দিয়েছে সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমে।

জনজীবনে গণমাধ্যমের প্রভাব অপরিসীম। সংবাদপত্রকে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনিবার্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রাষ্টের চতুর্থ স্তম্ভ হলো গণমাধ্যম, আর সাংবাদিকদের বলা হয় জাতীর বিবেক। তাই সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সাথে সাংবাদিকের পাঠকদের কাছে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও সংবাদ তুলে ধরাই মূল লক্ষ্য। ---দেশের প্রকৃত ও পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে। এসব হলুদ ও অপ-সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে এখনই সাংবাদিক নেতারা যদি কোনো ব্যবস্থা না নেন তাহলে স্বীকৃত এ পেশার স্থায়ীত্ব বেশিদিন থাকবে না বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)