

বৃহস্পতিবার ● ২৭ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু
প্রকাশ ঘোষ বিধানঃ
দেশের প্রাকৃতিক মধুর একমাত্র উৎপাদনস্থল সুন্দরবন। যেখানে বাঘের ভয় আর হাজারো প্রতিকূলতা ঠেলে মৌয়ালরা জীবন বাজি রেখে মধু সংগ্রহ করে। অদম্য সাহস আর ভয়কে জয় করে, প্রতিবছর মৌয়ালরা সুন্দরবনের প্রকৃতির সেরা সুমিষ্ট মধু আহরণ করে।
মধু হলো লাখ লাখ মৌমাছির অক্লান্ত শ্রম আর সেবাব্রতী জীবনের দান। মৌমাছিরা ফুলে ফুলে বিচরণ করে ফুলের রেণু ও মিষ্টি রস সংগ্রহ করে পাকস্থলীতে রাখে। তারপর সেখানে মৌমাছির মুখ নিঃসৃত লালা মিশ্রিত হয়ে রাসায়নিক জটিল বিক্রিয়ায় মধু তৈরি হয়। এরপর মুখ হতে মৌচাকের প্রকোষ্ঠে জমা করা হয়। মৌলেরা সুন্দরবনের গভীরে থাকা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে।
সুন্দরবনের মধুর রয়েছে আলাদা সুনাম। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক চাকের মধু হলো বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট মধু। কারণ বাংলাদেশের একমাত্র সুন্দরবনেই শতভাগ অর্গানিক মধু পাওয়া যায়। সুন্দরবন মানব সৃষ্ট বন নয় এবং সুন্দরবনের কোন গাছে কোন কীটনাশক বা রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয় না। এই ম্যানগ্রোভ বনে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবেই গাছপালা গুলো বেড়ে ওঠে। এবং বুনো মৌমাছির দল এসকল গাছের ফুল থেকে পুস্পরস সংগ্রহ করে তাদের মৌচাকে মধু হিসেবে জমা করে। এজন্য সুন্দরবনের চাকের মধু শতভাগ অর্গানিক এবং গুনে-মানে সবচেয়ে সেরা। সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত ও উত্পাদিত মধুর রং সোনালি হয়, যদিও লাল বা গাঢ় বাদামী বর্ণের মধুও পাওয়া যায়। সুন্দরবনের বিভিন্ন উদ্ভিদের ফুল থেকে মৌমাছিদের সংগৃহীত মধু মৌচাকে সঞ্চিত হয়।
সুন্দরবনের মধু সব থেকে উৎকৃষ্ট। পৃথিবীর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে হরেক রকম গাছ আছে। এখানে অনেক ধরনের জানা অজানা উদ্ভিদ জন্মায়। বাংলাদেশের আবহাওয়া মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে জুন মাস পর্যন্ত সুন্দরবনে নানান ধরনের ফুল জন্মায়। ফুল থেকে নেকটার নিয়ে মৌমাছিরা চাক তৈরি করে। সুন্দরবনে প্রধানত খলিশা, গড়ান, কেওড়া ও বাইন গাছের ফুলের মধু বেশি পাওয়া যায়। সাধারণত সুন্দরবনে মার্চের শেষ থেকে জুন মাস পর্যন্ত মধুর আহরণ চলে। এই সময় মধু সংগ্রহ করার জন্য মাওয়ালীরা দল বেঁধে বনের ভেতরে যায়। চাক থেকে সংগ্রহ করা মধু সারাদেশের সব থেকে উৎকৃষ্ট মানের মধু হিসেবে বিবেচিত।
সুন্দরবনে যেসকল ফুলের মধু পাওয়া যায় এর মধ্যে খলিশা, গরান, কেওড়া, বাইন, লতা ইত্যাদি ফুল উল্লেখযোগ্য। তবে এগুলোর মধ্যে খলিশা এবং গরান ফুলের মধুর স্বাদ সবচেয়ে সুস্বাদু। এই মধুর রঙ এবং ঘ্রাণ উভয়ই অধাধরণ। সুন্দরবনের মধু কিছুটা হালকা হয়ে থাকে কিন্তু খুবই সুস্বাদু টকটক মিষ্টি। আমাদের স্বাদু পানির অঞ্চলের মধু গুলোর ঘনত্ব বেশি হয়ে থাকে সুস্বাদুর দিক দিয়ে সুন্দরবনের মধুর মতো হয় না।
আবহাওয়া কারণে সুন্দরবনের এই মধুর ঘনত্ব সবসময় পাতলা হয়৷ বেশি পাতলা ঘনত্বের জন্য অনেকসময় পাত্র পরিবর্তনে বা ঝাঁকি দিলে এই মধুতে ফ্যানা তৈরি হয়। তবে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এই ফ্যানা আবার তরল মধুতে রুপান্তরিত হয়৷এই মধুর আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, মধু সংগ্রহের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে মধুর উপরে হলুদ রঙের ফুলের পরাগ রেণু জমা হয়। এটাকে স্থানীররা মধুর গাদ বলা হয়। তবে, এটি খুবই স্বাস্থ্যকর এবং একটি উন্নত প্রোটিনের উৎস।
খাদ্য ও ঋতুর বিভিন্নতার কারণে মধুর রঙ বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ কারণেই কোন বিশেষ অঞ্চলে কোন বিশেষ ফল-ফুলের প্রাচুর্য থাকলে সেই এলাকার মধুতে তার প্রভাব ও স্বাদ অবশ্যই পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া তাপমাত্রা,আদ্রতা ও সময়ের হেরফেরের কারণে মধু জমাট বাধতে পারে। কোনো কোনো সময় মধু ক্রিম আবার কখনও ক্রিস্টালাইজড হতে পারে।
মধু হলো পুষ্টির ভাণ্ডার। মধুতে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ডায়েটারি ফাইবার এবং পটাসিয়ামসহ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি রয়েছে। খাঁটি মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান বিদ্যমান। মধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ঠান্ডা, ত্বকের সমস্যা দূর করে। কার্বোহাইড্রেট আর প্রাকৃতিক চিনির সমৃদ্ধ এক উৎস মধু। নতুন সংগ্রহ করা মধু থেকে পুরোনো মধু বেশি কার্যকর। খাঁটি মধু চর্বি ও প্রোটিন মুক্ত। এ ছাড়া মধু খেলে তাৎক্ষণিক এনার্জি পাওয়া যায়।
বিশেষ করে সুন্দরবনের মধুতে বিভিন্ন ফুলের সংমিশ্রণ থাকায় তা রোগ প্রতিরোধ করার উপাদানে ভরপুর থাকে। বনের মধুতে অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন, খনিজ ও বিভিন্ন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বিদ্যমান। এগুলো দেহের জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া দূর করে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট