

শনিবার ● ১৭ মে ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শান্তি এবং ধৈর্যের প্রতীক কচ্ছপ; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে
শান্তি এবং ধৈর্যের প্রতীক কচ্ছপ; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে
প্রকাশ ঘোষ বিধান
ধরিত্রীর সবচেয়ে প্রাচীন জীব কচ্ছপ। সরীসৃপ পর্যায়ের উভচর প্রাণী কচ্ছপ। কচ্ছপেরা খুব বেশিদিন জীবিত থাকে। শক্ত খোলস দ্বারা আবৃত প্রাণীটি প্রাচীন প্রাণীদের মাঝে অন্যতম। অতি পরিচিত এই প্রাণীটি জলস্থল উভয় স্থানেই বাস করে। নদী, ডোবা, খাল-বিল, গভীর সমুদ্র, মাটির গর্ত কিংবা গাছের গুড়ি অথবা বালি সবখানে এদের বসবাস। তবে পৃথিবীর জলবায়ুর দ্রুত নেতিবাচক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে শান্ত স্বভাবের প্রাণীটি প্রায় বিলুপ্ত ।
শান্তি এবং ধৈর্যের প্রতীক হিসাবে কচ্ছপকে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জীব কচ্ছপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং আমাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনে সহায়তা করে। মানুষের মধ্যে এই প্রাণীটি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সারাবিশ্বে ২৩ মে পালিত হয় বিশ্ব কচ্ছপ দিবস। ২০০০ সাল থেকে আমেরিকান টরটয়েজ রেসকিউ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দিবসটি পালনে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিল। সেই থেকেই দিবসটি সারাবিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কচ্ছপ এবং তাদের বিলুপ্ত হওয়া আবাসস্থলগুলিকে রক্ষা করতে এবং সেই সাথে তাদের বেঁচে থাকতে এবং উন্নতি করতে সহায়তা করার জন্য মানুষের কাজকে উৎসাহিত করতে দিবসটি পালন করা হয়।
ঈশপের সেই খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প থেকেই সবাই কচ্ছপের সঙ্গে পরিচিত। গল্পে দ্রুতগতির খরগোশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিতে যায় ধীরগতির কচ্ছপ। আয়ুর লড়াইয়েও জয়ী কচ্ছপ। জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রচলিত আছে, কচ্ছপের মূর্তি থেকে যে পজিটিভ এনার্জি বেরোয়, তা আশপাশের মানুষের জন্য খুবই উপকারী। সেই কারণে ঘরে কচ্ছপ রাখলে তা সৌভাগ্য নিয়ে আসে।
পৃথিবীর প্রাচীন প্রাণিগুলোর মধ্যে অন্যতম কচ্ছপ। পৃথিবীতে কচ্ছপের ৩৪০টি প্রজাতি রয়েছে যাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতি অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। তবে এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের হিসাবে, বাংলাদেশে মোট ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ বা কাছিম রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি স্বাদু পানি ও পাহাড়ি এলাকার। পাঁচটি সমুদ্রের। সামগ্রিকভাবে কচ্ছপের প্রজাতির সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও ব্রাজিলে। এক সময় বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর, নদীনালা, বিল-বাওড়, পুকুরসহ বাড়ির আঙিনাতেই কচ্ছপ দেখা যেত। এখন আর তেমন দেখাই যায় না। যার মধ্যে কিছু প্রজাতি আরাকন কাছিম, শিলা কচ্ছপ, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ ও দিবা কচ্ছপ মারাত্মকভাবে বিলুপ্তির পথে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন এদের বাসস্থানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে থাকে।
বাংলাদেশে সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তন, পুকুর জলাশয়ে বিষ ও কীটনাশকের ব্যবহার, জমিতে সার প্রয়োগ, কচ্ছপের প্রয়োজনীয়তা না জানা, প্রাণী দেখামাত্রই মেরে ফেলা ইত্যাদি কারণে সংকটাপন্ন হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে জেলেদের ব্যবহার করা অবৈধ ট্রলিং জালে সামুদ্রিক কচ্ছপ আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া কচ্ছপের যখন ডিম দেওয়ার জন্য বালিয়াড়িতে যাওয়ার সময় হয়, তখন সমুদ্রে মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলেদের জালে আটকা পড়ে। আবার ট্রলারের পাখায় কাটা পড়ে মারা যায়। স্থলে থাকা কচ্ছপ বিলুপ্ত হচ্ছে নগরায়ণের ফলে। ধীরগতির এই প্রাণী নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর–ডোবা ভরাট, ঝোপ-ঝাড় বিনষ্ট, পানি দূষণ, খাদ্যাভাব ও মানুষের আক্রমণে পরিবেশের বন্ধু কাট্রা হারিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় ৩৪০ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে প্রায় একশত বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
কচ্ছপরা সাধারণত রাতের বেলা ডিম পাড়ে, মা কচ্ছপরা ডিমের জন্য গর্ত করে এবং সেখানে ২ থেকে ২০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার পর মা কচ্ছপ ডিমগুলোকে মাটি, বালি বা অন্য যেকোনো জৈব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়। মা কচ্ছপ ডিম পাড়ার পর ডিমগুলো প্রকৃতির দায়িত্বে রেখে চলে যায়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রজাতি বিশেষে ৬০ থেকে ১২০ দিন সময় লাগে।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) সামুদ্রিক কচ্ছপ সংকটাপন্নের পাঁচ কারণ উল্লেখ করেছে। যেমন, মাছ ধরা : জেলেদের মাছ ধরার সময় জালে আটকা পড়ে প্রচুর সংখ্যক কচ্ছপ মারা যায়। জালে জড়িয়ে, আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্যশৃঙ্খলে পরিবর্তনের কারণেও মারা যাচ্ছে অনেক কচ্ছপ। কচ্ছপ ও কাছিম ধরা : সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম খাওয়ার জন্য অনেকে তা সংগ্রহ করে। আবার কচ্ছপ ও কাছিমের মাংস খাওয়া হয়। এ ছাড়া এদের থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়। এসব কারণে মানুষ কচ্ছপ ধরে বিক্রি করে। উপকূলীয় উন্নয়ন : উপকূলের উন্নয়নের নামে অনেক দেশেই কচ্ছপের আবাস ধ্বংস করা হচ্ছে। এদের ডিম পাড়ার জন্য সংরক্ষিত স্থানে পর্যটকদের বেশি আনাগোনাও সংকটের একটি বড় কারণ। এছাড়া জাহাজ চলাচল, সমুদ্রের তলদেশের পরিবর্তনসহ নানা কারণ রয়েছে। দূষণ : প্লাস্টিক, পরিত্যক্ত মাছ ধরার যন্ত্রপাতি, তেল বর্জ্য ও অন্যান্য পদার্থ খেয়ে কিংবা পরিত্যক্ত জালের সঙ্গে জড়িয়ে অনেক কচ্ছপ মারা যায়। রাসায়নিক দূষণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া উপকূলে আলোর ঝলকানি ডিম পাড়ায় বাধা দেয়। জলবায়ুর পরিবর্তন : আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন এদের বাসস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তন, পুকুর, জলাশয়ে বিষ ও কীটনাশকের ব্যবহার, জমিতে সার প্রয়োগ, কচ্ছপের প্রয়োজনীয়তা না জানা, প্রাণী দেখামাত্রই মেরে ফেলা ইত্যাদি কারণে এই প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।
কচ্ছপ মাংসাশী ও তৃণভোজী উভচর জাতীয় প্রাণী। কচ্ছপ মানব সমাজে বিভিন্ন রকম উপকার করে থাকে। এরা সর্বভুক প্রাণী, এরা জলাভূমিতে, নদীনালায় মরা, পচা-গলা, ময়লা জিনিস খেয়ে জলকে পরিষ্কার রাখে এবং জল দূষণ রােধ করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং আমাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সহায়তা করে ।
কচ্ছপ বিভিন্ন প্রকার পােকামাকড় এবং মশার ডিম ও লার্ভা খেয়ে এদের বংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং বিভিন্ন রােগের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। কচ্ছপ আর কাছিম যেসব স্থানে বসবাস করে, ডিম পাড়ে সেই সব স্থানের বাস্তুতন্তের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা যে কোন জল ভাগের তীরবর্তী অংশের উদ্ভিদ জগতকে বেড়ে উঠতে ও পুষ্টি জোগানে সাহায্য করে। এই প্রাণিরা জলভাগের অবাঞ্ছিত ঘাস, উদ্ভিদদের খেয়ে এদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে, না হলে এগুলি মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যাবে এবং জলের বস্তুতন্ত্রের উপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। যেমন সবুজ কচ্ছপ, যারা সামুদ্রিক ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে। লেদার ব্যাক কচ্ছপেরা প্রচুর পরিমাণে জেলিফিশ খেয়ে বেঁচে থাকে, এই জেলিফিশ গুলি সাধারনত মাছের লার্ভা খেয়ে নেয়। ফলে এই কচ্ছপেরা জলের খাদ্য শৃঙ্খল রক্ষা করে।
বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে কচ্ছপ ধরা, মারা, শিকার, বিক্রি, বিপণন, স্থানান্তর, চাষ, পাচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশ্ববাজারে মানুষের উপাদেয় খাদ্য হিসেবে কচ্ছপের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাছাড়াও এরা রপ্তানী পণ্য ছিল, বিধায় এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। মানুষের খাদ্য হিসাবে কচ্ছপের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে গেছিল, তাই অতিরিক্ত আহরণ ও পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুণ বাংলাদেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। কচ্ছপের বাসস্থানের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও আহরণ বন্ধ করতে না পারলে শীঘ্রই এদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়বে। তাই কচ্ছপ ও কাছিম রক্ষায় সমন্বিতভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।