

শনিবার ● ২৪ মে ২০২৫
প্রথম পাতা » উপকূল » আইলার ১৬ বছর ; আজও উপকূলবাসীকে কাঁদায়
আইলার ১৬ বছর ; আজও উপকূলবাসীকে কাঁদায়
প্রকাশ ঘোষ বিধান, পাইকগাছা (খুলনা) ঃ ২০০৯ সালের ২৫ মে আজকের দিনে সর্বনাশা আয়লা লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলীয় জনপদ। প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাত হানার ১৬ বছর আজ। উপকূল দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অনেকে। সে দিনটির কথাও ভুলতে পারেনি কয়রা ও পাইকগাছাসহ উপকূলের মানুষ। ঝড়ে স্বজন হারানো মানুষের কান্না যেনো আজও শোনা যায়। বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সে কথা মনে করে আজও আতকে উঠেন। মুহূর্তের মধ্যেই বিস্তীর্ণ জনপদ যেন লন্ডভন্ড হয়ে ধ্বংস লীলায় পরিণত হয়। কাঁদায় স্বজন হারা মানুষকে।
২১ মে ২০০৯ তারিখে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় আইলার এবং উপকূলভাগে আঘাত হানে ২৫ মে। এর ব্যাস ছিলো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে, তবে পরে বাতাসের বেগ ৮০-১০০ কিলোমিটার হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি, সিডরের তুলনায় কম হয়েছে।
মালদ্বীপের আবহাওয়াবিদরা এর নাম আইলা দেন। আইলা’ শব্দের অর্থ ডলফিন বা শুশুকজাতীয় জলচর প্রাণী। ঘূর্ণিঝড় আইলা পটুয়াখালি, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। আইলার প্রভাবে নিঝুম দ্বীপ এলাকার সকল পুকুরের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। খুলনা ও সাতক্ষীরায় ৭১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্থ হয়েছে। ফলে তলিয়ে যায় খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। ৭৬ কিলোমিটার বাঁধ পুরোপুরি এবং ৩৬২ কিলোমিটার বাঁধ আংশিকভাবে ধ্বসে পড়ে। এই দুই অঞ্চলে প্রাণ হারিয়েছে মোট ১৯৩ জন।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, আইলায় প্রায় দুই লাখ একর কৃষিজমি নোনা পানিতে তলিয়ে যায়। আক্রান্ত এলাকাগুলোয় পানীয় জলের উৎস সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। প্রায় ২,০০,০০০ একর কৃষিজমি লোনা পানিতে তলিয়ে যায় (৯৭ হাজার একরের আমন ক্ষেত সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়) কাজ হারায় ৭৩,০০০ কৃষক ও কৃষি-মজুর। আক্রান্ত এলাকাগুলোয় পানীয় জলের উৎস সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। জলোচ্ছাস ও লোনা পানির প্রভাবে, গবাদি পশুর মধ্যে কমপক্ষে ৫০০ গরু ও ১,৫০০ ছাগল মারা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কয়েক মাস পর থেকে এলাকাগুলোয় গাছপালা মরতে শুরু করে ও বিরানভূমিতে পরিণত হয়। কমপক্ষে ৩,০০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় (২,৪৩,০০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়)। দুই লাখ ৪৩ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।
আইলা-পরবর্তী সময়ে উপকূল ভাগের মানুষের জীবনযাত্রায় আমুল পরিবর্তন এসেছে। ঘূর্ণিঝড় আইলার রেশ কেটে গেলেও তার ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে দক্ষিণাঞ্চলে। অনেকে এলাকা ছাড়া হয়েছে আবার অনেকের পেশা বদলে গেছে। জীবীকার তাগিতে। পুকুরে মিঠা পানির বদলে নোনা পানি। ফলে পানীয় জলের সংকট নিত্যদিনের ঘটনা। নোনা জলের আগ্রাসনে জমিতে উৎপাদন কমে যায়। উপকূল এলাকায় লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের ধানের বীজ সরবরাহ করছেন কৃষি অফিস। আইলার ১৬ বছর পরও বিভিন্ন বাঁধের ভাঙন মেরামত না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে উপকূলবাসী। সামান্য ঝড়ে জলবন্দী হয়ে পড়েছে উপকূলের মানুষ। কোনো কোনো গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কপোতাক্ষ আর খোলপেটুয়া নদীর জল।
ঝড়ের সময় শুরু হয় প্রাণ বাঁচাতে মানুষের দৌড়া-দৌড়ি, ছুটা-ছুটি। ঝড়ে কেউ হারিয়েছেন মা-বাবা, কেউ ভাই-বোন, কেউ বা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চরম কষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন। মানুষের আর্তি যেন থামছে না। ঝড়ে স্বজন হারানো মানুষের কান্না যেনো আজও শোনা যায়। বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সে কথা মনে করে আজও আতকে উঠেন।