শিরোনাম:
পাইকগাছা, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২

SW News24
বৃহস্পতিবার ● ১০ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সুন্দরবনের কেওড়ার ফুল,ফল ও মধু
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সুন্দরবনের কেওড়ার ফুল,ফল ও মধু
১৮৫ বার পঠিত
বৃহস্পতিবার ● ১০ জুলাই ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

সুন্দরবনের কেওড়ার ফুল,ফল ও মধু

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান

সুন্দরবনের কেওড়া ফুলের মনোরম রুপ এবং তীব্র সুগন্ধ মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফুলগুলো দেখতে নারীর ঝুমকো কানের দুলের মতন। কেওড়া গাছে ঋতুরাজ বসন্তে হলুদ রঙের ছোটো ছোটো ফুল ফোটে। এসব পুষ্পেরা উভয়লিঙ্গের হয়ে থাকে। দারুণ মিষ্টি একটি সুবাস রয়েছে এ ফুলের। সাধারণত ফাল্গুনে কেওড়া গাছে ফুল ফোটে আর চৈত্র-বৈশাখে ফল ধরে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত কেওড়া ফল পাওয়া যায়। দৃষ্টিনন্দন সুবাসিত কেওড়া ফুলের ঘ্রাণ এলোমেলো বাতাসের ভেলায় চড়ে বিমোহিত করে প্রকৃতি-পরিবেশ।

কেওড়া ফুলের তীব্র এবং মনোরম সুগন্ধে মানুষ আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফুল ব্যবহার করার সময় হয়তো কোনোভাবে জলের সংস্পর্শে এসে সেই সুগন্ধ জলে মিশে যায় এবং মানুষ সেটির ব্যবহার শুরু করে। ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারে যে কেওড়া মেশানো জল খাবারের স্বাদ ও গন্ধকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। এর ফলস্বরূপ, মিষ্টি খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য বিশেষ রান্নায় এর ব্যবহার শুরু হয়। পাতন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের পর কেওড়া ফুল থেকে সুগন্ধি নির্যাস বের করার পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়।

ফাল্গুনে ফুল ধরার পর ফুল থেকে ধীরে-ধীরে চৈত্র-বৈশাখে কেওড়া ফল তৈরি হয়। পরিপক্ব কেওড়া ফল বৃষ্টিভেজা আষাঢ়-শ্রাবণ পেরিয়ে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাওয়া এবং খাওয়া যায়। কেওড়া ফল দেখতে গোলাকার, অনেকটা ডুমুরের মতো। সবুজ রঙের ফলের ওপরের মাংসল অংশ টক স্বাদের। ভেতরে বেশ বড় বীজ। ফলের ব্যাস বড়োজোর ২ থেকে ৩ মিলিমিটার। একটি কেওড়া ফলে বীজের সংখ্যা ২৫ থেকে প্রায় ১২৫টির মতো। ভেতরের বড়ো বিচি বাদে ওপরের সবুজ বর্ণের মাংসল অংশ টক স্বাদে ভরপুর। সুন্দরবনের হরিণ ও বানরের কাছে কেওড়ার পাতা ও ফল ভীষণ রকমের প্রিয় খাবার।

বাংলাদেশের সুন্দরবন হল প্রকৃতির এক অপরূপ দান। সুন্দরবনের প্রধানতম বৃক্ষ কেওড়া। বনের সবচেয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত গাছ এটি। বনে কেওড়া গাছের উপস্থিতি পরিবেশের শোভা বৃদ্ধি করে। সুন্দরবন ও  নদী মোহনায় ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খালের কর্দমাক্ত চরাঞ্চলে কেওড়া গাছ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জন্মে। কেওড়া গাছের গোড়া ও এর চারপাশে খাড়া-খাড়া অজস্র শ্বাসমূল দেখা যায়, যা বায়ু সঞ্চালনে সহায়তা করে। যথাযথ পরিবেশে উদ্ভিদটি খুব দ্রুত বড়ো গাছে পরিণত হয়। কেওড়া গাছের উচ্চতা ২০ মিটারের মতো ও প্রায় ২.৫ মিটার চওড়া হয়ে থাকে।এ মন-মাতানো চিরসবুজ কেওড়া গাছের সবুজপত্রসমূহ সরু ও লম্বাটে, যা দেখতে অনেকটা তেজপাতার সদৃশ।

কেওড়া হলো সুন্দরবনের একটা খুব পরিচিত উদ্ভিদ। প্রকৃতিতে কেওড়া গাছের বিভিন্ন প্রজাতি আছে যা ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু এবং মাটির ধরনে বিকশিত হয়েছে। কিছু প্রজাতি প্রধানত ফল উৎপাদনের জন্য পরিচিত এবং অন্য কিছু প্রজাতি  কাঠের কাজে ব্যবহৃত হয়। উপকূলের যত্রতত্র কেওড়া পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার আর চীন ছাড়া সারা দুনিয়ায় কোথাও কিন্তু কেওড়া নেই। আছে কেওড়ার অন্য প্রজাতি। কেওড়ার চার প্রজাতির এর মধ্যে দুই প্রজাতি বাংলাদেশে কেওড়া ও ওড়া বা ছইলা। আর দুই প্রজাতির মধ্যে অ্যালবা শ্রীলঙ্কায় আর ওভাটা দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ায়। ওড়া সবখানেই আছে। এছাড়াও, প্রাকৃতিক পরিবেশে এটির উপস্থিতি জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য।

সুন্দরবনের মধু জগদ্বিখ্যাত আর এই মধুর একটি বড়ো সংগ্রহশালা কেওড়া ফুল। সুন্দরবনের কেওড়া ফুলের দুর্লভ মধু যা কেওড়া গাছের ফুল থেকে মৌমাছি সংগ্রহ করে। এই মধু প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবনের বন্য পরিবেশে উৎপন্ন হয়। কেওড়া ফুলের মধু তার সোনালি-হালকা বাদামি রঙ, সুগন্ধ এবং মিষ্টি স্বাদের জন্য পরিচিত।

কেওড়া গাছের ঔষধি গুণাবলী প্রাচীনকালের থেকেই মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রচলিত। গাছটির প্রতিটি অংশ থেকে ঔষধি উপাদান আহরণ করা যায় যা বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর।

সুন্দরবন ঘেঁষা উপকূলীয় জনপদ-সমূহের লোকজনের সুদীর্ঘ প্রাচীনকাল হতে কেওড়া ফল কাঁচা খাওয়ার পাশাপাশি সঙ্গে ডিমওয়ালা গোদা চিংড়ি মাছ ও মসুর ডালের খাট্টা রান্না করে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে ফলের মৌসুমে উপকূলীয় হাট-বাজারে ১০-২০ টাকা কেজি দরে সাধারণত কিছু পরিমাণে কেওড়া ফল বিক্রি হতে দেখা যায়। স্বল্প-পরিসরে গৃহিণীদের কেউ কেউ কেওড়া ফল থেকে আচার ও চাটনি তৈরি করে থাকে।

কেওড়া গাছের ইতিহাস বহু প্রাচীন। হাজার বছরের পরেও বাংলাদেশে এটির ব্যবহার ও গুরুত্ব অটুট রয়েছে। প্রাচীন সাহিত্য ও লোককথায় এই গাছের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন প্রজন্মের লোকেরা বিশ্বাস করে যে এই গাছ তাদের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। ঐতিহাসিকভাবে কেওড়া গাছ বাংলাদেশের উপকূলীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কেওড়া গাছ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)