

বুধবার ● ১৫ অক্টোবর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের অবদান ও স্বীকৃতি
অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের অবদান ও স্বীকৃতি
প্রকাশ ঘোষ বিধান ;
সভ্যতা আর প্রযুক্তির দিক দিয়ে উন্নয়নের ধারায় পৃথিবী এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে রয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। বিশেষ করে গ্রামের নারী সমাজ। গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানা ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা স্মরণীয়। নারী সমাজ জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবুও গ্রামীণ নারীরা পারিবারিক নির্যাতন আর কর্মক্ষেত্রে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দেশীয় নারী সংগঠন নারীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হলেও সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারেনি গ্রামের নারীরা। আর তাই তাদের জন্যই আজকের এই দিবসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের অবদান বহুমুখী, যার মধ্যে রয়েছে কৃষি, পশুপালন, হস্তশিল্প এবং ছোট ব্যবসার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখা। তারা প্রায়ই গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি এসব কাজে যুক্ত থাকেন, যা পরিবারের সচ্ছলতা ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় সাহায্য করে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা অনলাইন বাজারজাতকরণ, আর্থিক লেনদেন এবং কৃষি সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তিতে সক্ষম হচ্ছে, যা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও প্রসারিত করছে।
আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর পালিত হয়। দিবসটিতে বিশ্বজুড়ে গ্রামীণ নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি এবং তাদের অধিকার ও উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত এই দিবসটি গ্রামীণ নারীদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক উন্নয়নে তাদের ভূমিকা তুলে ধরতে সাহায্য করে।
১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের চতুর্থ নারী সম্মেলনে ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এই প্রস্তাবকে চূড়ান্তভাবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই দিবসটি উদযাপন করে আসছে। এর মূল উদ্দেশ্য গ্রামীণ অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সামগ্রিক উন্নয়নে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। শহর ও গ্রামের নারীদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন ও অধিকার নিশ্চিত করা। গ্রামীণ নারীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া।
গ্রামীণ নারী বলতে সাধারণত গ্রামের নারীদের বোঝানো হয়, যারা কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গ্রামীণ নারীরা তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়ের উন্নতিতে কাজ করে এবং শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তাদের ক্ষমতায়ন করতে পারে। গ্রামীণ নারীরা ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনের সাথে জড়িত, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ রাখে।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় সাতশত কোটি লোকের অর্ধেক নারী। বাংলাদেশে ৮৬ হাজারেরও অধিক গ্রাম রয়েছে। দেশের ৮০ ভাগ জনগণই গ্রামে বসবাস করে। দেশের জনগণের অর্ধেক নারী। আবার এ অর্ধেক নারীর সিংহ ভাগই বসবাস করে গ্রামে। বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামীণ অবস্থা বদলে যাচ্ছে। গ্রামে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। যার সিংহভাগ অবদান নারীর। গ্রামে বসবাস করা মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দারিদ্র্যের শিকার। দারিদ্র্য দূরীকরণে শহর ও গ্রামে আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও অর্জনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা ও অংশীদারিত্ব উন্নয়নের বিষয়টি রাষ্টীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে গ্রামীণ নারীরা এখনো উচ্চশিক্ষা বা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাবঞ্চিত এই নারীরা কৃষি, মাছচাষ, হাতের কাজ, সেলাই প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। গ্রামীণ নারীরা সংসারের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার পরও বাড়তি আয় উপার্জনের জন্য, আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ মেটানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পের কাজ করে থাকে। গ্রামীণ অর্থনীতির উপার্জনে মহিলাদের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বাঁশ ও বেতের কাজ, পোলট্রি শিল্প, মৃৎ শিল্প, মৎস্য চাষ, শাকসবজি চাষ,গবাদি পশু পালন,নকশি কাঁথাসহ বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পের কাজ করে থাকে।
গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের এই অবদান অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও এর নেই কোনো স্বীকৃতি, নেই কোনো সরকারি পৃষ্টপোষকতা। নারীদের এই অর্থনৈতিক সংগ্রাম অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে হয়ে থাকে। যার পেছনে রয়েছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচকতা, পারিবারিক অসহযোগিতা, নারীদের বন্দিদশা সবকিছু মিলিয়ে বেশ কঠিন।
আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নারীরা আলাদাভাবে বিশেষ মাত্রায় দারিদ্র্যের শিকার। আয়- দারিদ্র্য ও পুষ্টিগত অবস্থার ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য বিদ্যমান। পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী শ্রমিকদের আয় অনেক কম। নারীদের খাদ্যসহ গড় ভোগ যে কম তা তাদের চরম অপুষ্টি, মৃত্যুহার এবং রুগ্নতার তীব্রতা থেকে প্রতীয়মান হয় । আয়-দরিদ্র, মানবদরিদ্র হ্রাসে ও শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হলেও সমস্যা এখনও বিদ্যমান।
অধিকার সুপ্রতিষ্ঠা ও জেন্ডার উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের সমস্যা বহুমুখী। পল্লী অঞ্চলে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, গর্ভকালীন নির্যাতন, আত্মহত্যা ও শিশু নিপীড়ন, মাদকাশক্তি ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট নির্যাতনের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। গ্রামে ধনী পরিবারগুলোতে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক লেনদেন ইত্যাদি নির্যাতনের চর্চা রয়েছে। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা যৌতুকের শিকার, নারী ও শিশু নিপিড়নের ঘটনা বিদ্যমান। তাই পল্লী অঞ্চলে বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্ভুত সমস্যা মোকাবেলার জন্য এবং জেন্ডার অধিকার চর্চা, সমাজে নির্যাতনের শূন্য সহনীয় অবস্থানের পরিবেশ তৈরীর জন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সচেতনতার জন্য জীবনমুখী, টেকসই ও অগ্রসর আইনী শিক্ষা।
শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কারণে শহরের নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হলেও গ্রামীণ নারীরা থেকে যাচ্ছে পিছিয়ে। তাছাড়া নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সার্বিক সহযোগিতা, সহজশর্তে ঋণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, ঋণের সুদ যথাসম্ভব কমিয়ে, সঠিক তদারকির মাধ্যমে গ্রামের নারীদের যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা যায়, তাহলে পুরো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট