

বৃহস্পতিবার ● ৩১ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সুবিধাবঞ্চিত পথ শিশুদের ঈদ-আনন্দ
সুবিধাবঞ্চিত পথ শিশুদের ঈদ-আনন্দ
প্রকাশ ঘোষ বিধান
ঈদ মানেই খুশি। আর ঈদ এলেই সবচেয়ে বেশি খুশি হয় শিশুরাই। তবে সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা ঈদের আনন্দে সামিল হতে হতাশা ভরা মুখ নিয়ে খুজে ফিরে একটু সহনুভুতি। প্রজন্মের সবিধা বঞ্চিত, সমাজের অবহেলিত ছেলে মেয়েরা বিত্তবানদের পানে চেয়ে থাকে আশাতুর চেখে। তারা ভাসমান, তারা ঠিকানহীন, পথ-ই তাদের ঠিকানা, জন্ম তার পথে, তাই হয়তো বা তাদের নাম হয়েছে পথশিশু। এখন সমাজে পথশিশু নামটি ব্যাপক পরিচিত। পথশিশুদের ঈদ যেন পথে না হয়। তাদের ঈদের এই দিনটি কাঁটে বিত্তবানদের দয়ার উপর।
মুসলমানদের বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের একটি হলো ঈদুল আযহা। যাহা কোরবানীর ঈদ নামে পরিচিত। আরবী ঈদুল আযহা এর আবিধানিক অর্থ হল ত্যাগের উৎসব, আর আরবি কুরবানী শব্দের অর্থ যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। শব্দটি আবার ত্যাগ করা, বিসর্জন দেয়া ও উৎসর্গ করা অর্থ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঈদুল আযহার দিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো আল্লাহর নামে কুরবানী করা। পশু যবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় বলে এ পশু যবেহকেই কুরবানী বলা হয়। নিয়ম অনুসারে কুরবানীর গোশস ৩ ভাগ করে। একভাগ কুরবানীদাতা, একভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বাকী একভাগ গরীবদের মাঝে বিতরণ করতে হবে।
আমরা জানি ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। ঈদের আনন্দ একার নয়, যে খুশি ছড়িয়ে যাবে সবার মাঝে। ধনি-গরীব কোন ব্যবধান নয়। সবার মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি করে তা হবে মহা আনন্দের উৎসব। যে খুশির কোন সিমানা থাকবে না। আমাদের সমাজে সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা রয়েছে। যারা আজ পথশিশু হিসাবে পরিচিত। তাদেরও ঈদ আছে। রাজধানী সহ সারাদেশে কয়েক লাখ পথশিশু রয়েছে। তারা পরিবার বা পরিবারহীন ভাসমান জীবন যাপন করে।
দেশে বাড়ছে পথশিশুর সংখ্যা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দেশের রাজনৈতিক দলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি এসব নানাবিধ কারণে বাড়ছে পথশিশুর সংখ্যা। ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২ শীর্ষক জরিপ প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। জরিপে রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশুদের মোট সংখ্যা না থাকলেও ইউনিসেফ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হতে পারে। যাদের ৮০ ভাগেরই জন্ম হয় পথে। তাদের বেড়ে ওঠা ও বসবাস ফুটপথে। স্বজনহারা অনেক শিশু শহরে এসে এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তাদের পথ-ই ঠিকানা। যাদের দেখভাল করার কেউ নেই। তাদের দিন কাঁটে অন্যের দয়ার উপর। অবহেলা-অযত্নে বেড়ে ওঠা এই শিশুদের টোকাই, ছিন্নমূল বা পথশিশু বলা হয়। এরাও আমাদের এই সমাজেরই সন্তান।
শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু নিম্নবর্গীয় পথ শিশুদের নিয়ে আমাদের ভাবনা ও পরিকল্পনা কম। মানবতার বিকাশ এবং জাতির বৃহত্তম স্বার্থে পথ শিশুদের শিক্ষা আবশ্যক। দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে পথ শিশুদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ দিয়ে সমাজের মূল ধারায় পুনর্বাসিত করতে হবে। সরকারের উচিত পথ শিশুদের সম্পর্কে সচেতন হওয়া। তবে এসব কাজ করা সরকারের একার পক্ষে হয়তো সম্ভব না, সে ক্ষেত্রে যে সংস্থাগুলো পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে সরকারের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। সরকারের পাশাপাশি ওই সংগঠনগুলো যদি এসব পথ শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করে, তাহলে এ পথ শিশুদের মধ্য থেকেও আমরা উন্নত জাতি গঠন করতে পারবো। পথ শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শিশুর রয়েছে সমান অধিকার। সচেতন থাকতে হবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এরা যেন অল্প বয়সেই হারিয়ে না যায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানহীন শিশুরা যেন পরবর্তীকালে জাতির কাঁধে বোঝা না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা সকলেরই উচিত।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। আর ঈদ এলেই শিশুদের খুশির সিমানা ছাড়িয়ে যায়। বাবা-মার কাছ থেকে নতুন জামা-কাপড়, ঈদ সেলামি পেয়ে এবং পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিনোদন উপভোগ করে শিশুরা। ঈদকে ঘিরে বাবা-মার কত পরিকল্পনা থাকে শিশুদের নিয়ে। তবে সব শিশুর ভাগ্য এক রকম হয় না। আমাদের আশপাশে অনেক শিশুই রয়েছে ঈদে নতুন পোশাক পড়তে পারে না। সামাজিক অসংগতির শিকার হচ্ছে অনেক শিশু। এদের অধিকাংশই পথশিশু। অভুক্ত মলিন নিষ্পাপ এসকল শিশুরা অধিকাংশই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।
দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর শিশুর জন্য ঈদ আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ঈদের নতুন পোশাক ও ভালো খাবার পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়। এযেন প্রতিটি শিশুর মনে আলোর উৎসবে সমাজকে আলোকিত করা।
আমাদের সমাজে প্রচুর ধনি ব্যক্তি আছেন। তারা নিজের জন্য অনেক খরচ করেন। ঈদ নিজের বচ্চাদের কেনাকাটায় প্রচুর অর্থ ব্যায় করেন। আমরা যদি পথশিশুদের কথা একটু ভেবে নিজের প্রচুর কেনা কাটার মধ্য থেকে একটু খরচ বাঁচিয়ে পথশিশুদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া সম্ভব হয়, তবে পথশিশুরাও ঈদ আনন্দে মেতে উঠতে পারবে। পথশিশুদের মুখে হাঁসি ফুঁটাতে বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রয়োজন একটু সহযোগিতাপূর্ণ মনভাব। পথশিশুরা আমাদের সমাজের সন্তান। তারা আমাদের ভালবাসার দাবীদার। এসব পথশিশুদের পিতা মাতা সহ পরিবার পরিজন চরম দারিদ্র সীমার নিচে মানবেতর জীবন যাপন করে। এদের অনেকের সংসার চলে ভিক্ষার উপর। আমরা সবাই মানুষ। আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব রয়েছে, তাই মানুষের কল্যাণে বিত্তবানদের সাহায্য করার হাত বাড়াতে হবে। আশেপাশে পথশিশু ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের প্রতি আর্থিক ও সার্বিক সহযোগিতা দিতে হবে। যাতে তাদের মধ্যে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। পথশিশুদের ঈদ যেন পথে-পথে না হয়।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট