

রবিবার ● ১৯ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ সুন্দরবন সুন্দর থাকুক
জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ সুন্দরবন সুন্দর থাকুক
প্রকাশ ঘোষ বিধান
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি। বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম সুন্দরবন। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি।
১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ৫শত ১৭ বর্গ কিলোমিটার ৬৬ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ ৩৪ শতাংশ রয়েছে ভারতের মধ্যে। ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ২ হাজার বছর আগে সুন্দরবনের মোট আয়তন ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার ছিল। একসময় যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরিশাল বা পুরোনো বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে সুন্দরবন ছিল।
সুন্দরবন ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে; যথাক্রমে সুন্দরবন ও সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান নামে। ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে সুন্দরবন দিবস।
মঘল আমলে ১২০৩-১৫৩৮ স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর এর কাছ থেকে স্বত্বাধিকার পাওয়ার পরপরই সুন্দরবন এলাকার মানচিত্র তৈরি করা হয়। বনাঞ্চলটি সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতের তৎকালীন বাংলা প্রদেশে বন বিভাগ স্থাপনের পর থেকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বনের উপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করেছে। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্ত্বাধীকার অর্জন করে। এল. টি হজেয ১৮২৯ সালে সুন্দরবনের প্রথম জরিপ কার্য পরিচালনা করেন। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে। যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪.৩% এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৬৬%।
সুন্দরবন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের মুকুট ধরে রেখেছে। ম্যানগ্রোভ বন মানে সমুদ্রের উপকূলবর্তী বন। ম্যানগ্রোভ শব্দটি পর্তুগিজ শব্দ ম্যাঙ্গু থেকে এসেছে। এর অর্থ বৃক্ষ। আর ইংরেজি শব্দ গ্রোভ অর্থ অগভীর, বালুকাময় বা কর্দমাক্ত এলাকায় পাওয়া গাছকে বোঝায়। অর্থাৎ যে বন সমুদ্রের নোনা পানিতে সাময়িক সময় ডুবে থাকে, সেটাই ম্যানগ্রোভ বন। আরও সহজ কথায় বলা যায়, লবণাক্ত বনাঞ্চল। সুন্দরবনে প্রতিদিন দুইবার জোয়ার হয়। পানির স্তর ৬-১০ ফুট বাড়লে মুখ্য জোয়ারের সৃষ্টি হয়।
বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সুন্দরী গাছ। এ বনের প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরী গাছ। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে, এ কথা বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করলেও সবাই করে না। অনেকের মতে, সমুদ্র বন বা চন্দ্র-বাঁধে নামে এক প্রাচীন আদিবাসীর নামে এ বনের নামকরণ করা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে। সুন্দরবন স্থানীয়ভাবে বাদা বা, হুলোবন, শুলোবন, মাল, মহাল হিসেবে পরিচিত। বাদা মানে জোয়ার-ভাটা বয়ে যায় যে বনে। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় এই বাদার নাম হয়ে যায় মহাল, মধুমহাল, গোলমহাল।
সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৯০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীসহ সাড়ে চারশ প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির ও অজগর সাপ। তবে এ বনের প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসে আয়তন হ্রাস পেয়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দিন যত বয়ে যাচ্ছে, আয়তন তত হ্রাস পাচ্ছে।
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য সুন্দরবন প্রসিদ্ধ। এটি এই প্রাণীর জন্য সংরক্ষিত অঞ্চল। তাই ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারপরেও বাঘের চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। ২০০৪ সালের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, সুন্দরবনে বাঘ ছিল মোট ৪৪০টি। ২০১৮ সালের মধ্যে তা কমে মাত্র ১১৪টিতে। বর্তমান বাঘ গণনা ১২০টিতে দাড়িয়েছে।
সুন্দরবনে মোট ১০২টি দ্বীপ রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টিতে মানুষের যাতায়াত থাকলেও বাকি ৪৮টি পুরোপুরি জঙ্গলে ছাওয়া। গোসাবা দ্বীপের অবস্থান ভারতে। সুন্দরবনের এই দ্বীপেই সবচেয়ে বেশি মানুষের বাস। বনের মোট আয়তনের প্রায় ৪০ শতাংশ জুড়ে এ দ্বীপ। দ্বীপ শেষ হলেই ঘন জঙ্গল। এ দ্বীপে রয়েছে নিজস্ব হাসপাতাল, সরকারি স্কুল, অফিস ও পঞ্চায়েত। দ্বীপটিতে ৫ হাজারের বেশি মানুষের বাস। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৪০ শতাংশ রয়েছে ভারতে। বাকিটা বাংলাদেশের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় রয়েছে।
সুন্দরবনে এক থেকে দেড় হাজার বছরের পুরোনো মানববসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। হাজার বছর আগে ব্যবহৃত মানুষের বিচিত্র বেশ কিছু ব্যবহার্য সামগ্রীও পাওয়া গেছে। এটা ২০১৮ সালে ইসমে আজম নামে এক গবেষকের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে এসব নিদর্শন উদ্ঘাটিত হয়েছে। সুন্দরবনের খেজুরদানা, আড়পাঙ্গাশিয়া ও শেখেরটেকে সবচেয়ে বড় স্থাপনাগুলোর সন্ধান পাওয়া গেছে। আরও কিছু স্থাপনার খোঁজ মিলেছে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশের খোলপটুয়া নদীতীরে এবং খুলনা অংশের কটকায়। ঢেউয়ের তোড়ে নদীর পাড় ভেঙে মাটির আস্তরণ সরে যাওয়ায় পুরোনো এসব স্থাপনা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এর আগেও সুন্দরবনে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের ১৯৯৮ সালের জরিপ এবং বন বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও মালয়েশিয়ার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে কিছু স্থাপনার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। গবেষকদের ধারণা, এগুলো অন্তত এক হাজার থেকে বারো শত বছরের পুরোনো।
১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যের জন্য অনন্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য বিখ্যাত এই বন। এই বাঘগুলো বনের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো রক্ষা করে। সাইক্লোন এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় ঢাল হিসেবে উপকূলবাসীকে আগলে রাখে। সুন্দরবন একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে নৌকাভ্রমণ, পাখি দেখা, এবং বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করার মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে।
সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। এই বন পরিবেশগত সুরক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পর্যটনের জন্য অপরিহার্য।সুন্দরবনের অনন্য জীববৈচিত্র্য, দ্বীপ, এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ রক্ষা এবং মানুষের জীবনযাত্রা সুরক্ষিত রাখতে সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সুন্দরবন সুরক্ষার জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সুন্দরবন স্থানীয় অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকা শক্তি। আমাদের জাতীয় সম্পাদ এই বনভূমিকে রক্ষা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এর ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা উচিত।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট