

শনিবার ● ১৪ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » সুন্দরবন » ডাকাত আতঙ্কে সুন্দরবনে মধু আহরণ কমেছে
ডাকাত আতঙ্কে সুন্দরবনে মধু আহরণ কমেছে
দেশে প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন। প্রতিবছর এপ্রিল-মে দুই মাস সুন্দরবন থেকে মধু আহরণের অনুমতি পান মৌয়ালরা। ঘ্রাণ ও স্বাদে অতুলনীয় এই মধু আহরণে জীবনবাজি রাখতে হয় মৌয়ালদের। এত দিন শুধু সুন্দরবনের নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয় ছিল। এবার ছিল বনদস্যুদের ভয়ও। দস্যুদের ভয়ে মধু আহরণে যাননি অনেক মৌয়াল। সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হলেও দস্যু আতঙ্কে এবার অর্ধেকে নেমেছে মৌয়াল ও নৌকার সংখ্যা। বনে মৌয়ালদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গত বছরের তুলনায় এবার মধু আহরণ কমেছে ৩৫ শতাংশ।বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে সুন্দরবন থেকে মোট ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু সংগ্রহ করা হয়েছিল। এবার সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৬ কুইন্টালে, যা গতবারের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ কম। গত বছর প্রায় ৮ হাজার মৌয়াল মধু আহরণে নিয়োজিত ছিলেন। এবার নেমে এসেছে প্রায় ৫ হাজারে।
কয়রার গোবরা গ্রামের মৌয়াল জাহিদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাপ-দাদার পেশা হিসেবে সুন্দরবনে মধু কাইটে আসতিছি, কখনো পিছপা হইনি। আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। তবে এবার ডাকাতির ভয়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে যাইতে পারিনি। তাই মধু একটু কম পাইছি। ভয়ে এলাকার অধিকাংশ মৌয়াল এবার জঙ্গলে যায়নি।
শরণখোলার স্থানীয় মৌয়ালরা জানান, সম্প্রতি সুন্দরবনে দস্যুদের পুনরাবির্ভাব তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। খুড়িয়াখালী গ্রামের মজিদ ফরাজী (৫৫) বলেন, ১৫ বছর ধরে মধু সংগ্রহ করি, কিন্তু এবার প্রথম যাচ্ছি না। দস্যুরা ধরে নিয়ে দুই-তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
মধু সংগ্রহ কমার পেছনে ডাকাত আতঙ্ক ছাড়াও আরও দুটি কারণ আছে বলে জানিয়েছেন মৌয়ালরা। তাঁদের ভাষ্য, আগে বন বিভাগ তিন মাস মধু আহরণের অনুমতি দিত। কিন্তু চার বছর ধরে দুই মাস মধু সংগ্রহ করতে দিচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণা করে মধু আহরণের অনুমতি দেয় না বন বিভাগ। মধু আহরণ কমার পেছনে এ দুটি কারণও দায়ী।
সুন্দরবনে মধু আহরণ কমে যাওয়ার পেছনে আরও একটি কারণের কথা বলেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তাঁর ভাষ্য, সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুমের আগে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হলে গাছে গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে গাছে ফুল ফোটার পরিমাণ কমে যায়। আবার ফুল ফুটলেও দ্রুত তা ঝরে যায়। এ কারণে ফুল থেকে মৌমাছি আগের মতো মধু আহরণ করতে পারে না। এ জন্য সুন্দরবনে মধুর পরিমাণ কমে গেছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২৩ সালে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৪ সালে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এবার কমে হয়েছে ২ হাজার ৭৬ কুইন্টাল। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল আড়াই হাজার কুইন্টাল।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের পূর্ব অংশে এমনিতেই মধু কম হয়। তার ওপর এবার ডাকাত আতঙ্কে মৌয়ালরা অনেকেই বনে যাননি। এ কারণে মধু সংগ্রহ কমে গেছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, মৌয়ালদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। বনাঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি মৌয়ালদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আশা করছেন, আগামী বছর পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে।