শিরোনাম:
পাইকগাছা, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২

SW News24
সোমবার ● ৬ অক্টোবর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » অর্থনীতির বিকাশে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ; এদের রক্ষা করুন
প্রথম পাতা » মুক্তমত » অর্থনীতির বিকাশে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ; এদের রক্ষা করুন
৭৩ বার পঠিত
সোমবার ● ৬ অক্টোবর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

অর্থনীতির বিকাশে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ; এদের রক্ষা করুন

---  প্রকাশ ঘোষ বিধান

পরিযায়ী পাখিরা কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, তারা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিযায়ী পাখিরা ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ভিদের পরাগায়ন ঘটিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, যা খাদ্য শৃঙ্খল ও জীববৈচিত্র্য বজায় রাখতে অপরিহার্য। তাদের উপস্থিতি নৈসর্গিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে। এই পাখিরা পরিবেশের স্বাস্থ্য ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পরিযায়ী পাখি আমাদের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করছে। ফুল ও শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ ও ফলের বীজ ছড়াতে সাহায্য করে, যা উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি ও বনাঞ্চল তৈরিতে সহায়তা করে।ফসলের পরাগায়নে পাখি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠা জমিতে পড়ে মাটিকে পুষ্টি জোগায় এবং জমির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে।

পরিযায়ী পাখিদের একটি  অংশ ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে রক্ষা করছে। পরিযায়ী পাখিরা ক্ষতিকর পোকামাকড় ও ইঁদুর খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর ফলে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব উপায়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্য উত্পাদন সম্ভব হয়। ফলে ক্ষেতের ফসল বিনষ্টকারী পোকাগুলো পাখিরা খেয়ে কৃষি অর্থনীতিতেও রাখছে আরেক ভূমিকা।

পরিযায়ী পাখিদের আরেকটি অংশ শিকারি পাখি। যারা মাঠ-প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। আর ইঁদুর জাতীয় প্রাণি খেয়ে থাকে, যা কৃষকের ফসলের ক্ষতি করে থাকে। পাখিগুলো বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রাণী খেয়ে কৃষককে সাহায্য করছে। পাখিরা ফসলের পাশাপাশি গৃহপালিত পশুদেরও অনেক উপকার করে। গৃহপালিত পশুদের লোমে এক ধরনের পোকা বাসা বাঁধে। পাখিরা সেই পোকা খেয়ে তাদের উপকার করে।

পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতিই  পরিযায়ী। বাংলাদেশে ৭০০ এর অধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। পরিযায়ী পাখিদেরকে আগে অতিথি পাখি বলা হতো। কিন্তু নিবিড় গবেষণায় দেখা গেছে যে, এরা অতিথি নয়। বরং যে দেশে যায় সেখানে তারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত বাস করে। অর্থাৎ বছরের বেশ কয়েকমাস এসব পাখি ভিনদেশে থাকে, নিজ দেশে বাস করে স্বল্প সময়ের জন্য।

শীতকালে পরিযায়ী পাখির আগমনে প্রকৃতিতে এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্য ও সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, যা পর্যটন শিল্পেও ভূমিকা রাখে।  শীতকালে তাদের ঝাঁকে ঝাঁকে আগমনে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যা ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশ-পর্যটনকে উৎসাহিত করে। জলাভূমি ও হাওর-বাওড় এলাকার মতো স্থানগুলো পরিযায়ী পাখিদের বিচরণের জন্য প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে এবং এই স্থানগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের বিশাল ঝাঁক জলাভূমি, হাওর-বাওড় ও অন্যান্য অঞ্চলে ভিড় করে, যা প্রাকৃতিক দৃশ্যকে আরও মনোরম ও আকর্ষণীয় করে তোলে এবং পর্যটকদের মুগ্ধ করে। পরিযায়ী পাখিদের দেখার জন্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওর, নিঝুম দ্বীপ, হাকালুকি হাওর ইত্যাদি স্থানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ে, যা ইকো-ট্যুরিজম এবং বার্ড-ওয়াচিং-কে উৎসাহিত করে। পর্যটকদের আগমনের ফলে হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন এবং গাইড সার্ভিসসহ বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশে সহায়তা করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিযায়ী পাখিদের পরিযানের সময় ও গন্তব্য পরিবর্তিত হয়। এছাড়াও দীর্ঘ যাত্রা পরিযানের সময় অনেক পাখি সাগরে পড়ে যায় কিংবা ঝড়ে কবলিত হয়। বন উজাড় ও জলাভূমি ভরাটের ফলে পরিযায়ী পাখিদের বাসস্থান হারিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক পরিযায়ী পাখি শিকারের শিকার হচ্ছে। পরিযায়ী পাখিদের দীর্ঘ যাত্রাপথে খাদ্য, আশ্রয় ও বিশ্রামের জন্য জলাভূমি, বনভূমি ও তৃণভূমির মতো প্রাকৃতিক আবাসস্থল অপরিহার্য।

১৯৭৪ সালে বন্য প্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি ১ বছর জেল, ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডিত। এই অপরাদের পুনরাবৃত্তি হলে অপরাধীদের ২ বছর জেল, ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী,  পরিযায়ী পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা পরিবহন করেন, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আইন বহাল রয়েছে। কিন্তু আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এই মৌসুমে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। পেশাদার ছাড়াও অনেক শৌখিন শিকারি পরিযায়ী পাখি শিকারের মহড়া দেন। এতে প্রতিদিনই শত শত পরিযায়ী পাখি মারা পড়ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের দেখা যায়, যা সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করে। পরিযায়ী পাখি এবং তাদের আবাসস্থলগুলো বর্তমানে হুমকির মুখে, যা এদের বিলুপ্তির কারণ হতে পারে। এদের সংরক্ষণে বনায়ন এবং পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন জরুরি, যা তাদের নিরাপদ আশ্রয় ও খাদ্যের যোগান দিতে পারে।

পরিযায়ী পাখিরা কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বরং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে, কৃষি ও বনায়নকে সহায়তা করতে এবং একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র নিশ্চিত করতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। পরিযায়ী পাখি অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে রয়েছে; পরিবেশগত মূল্য পরিযায়ী পাখি বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা জৈবিক বৈচিত্র্য এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখে।

পরিযায়ী পাখিরা পরিবেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিযায়ী পাখিরা একটি সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে এবং প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তাই এদের রক্ষা করা জরুরি।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ