শিরোনাম:
পাইকগাছা, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২

SW News24
সোমবার ● ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ও উপকূলীয় বালুচরের নিচে আছে মিঠাপানির ভান্ডার
প্রথম পাতা » মুক্তমত » ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ও উপকূলীয় বালুচরের নিচে আছে মিঠাপানির ভান্ডার
৩৩ বার পঠিত
সোমবার ● ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ও উপকূলীয় বালুচরের নিচে আছে মিঠাপানির ভান্ডার

--- প্রকাশ ঘোষ বিধান

সুন্দরবনের চরে বা বনের গভীরে মাটির গর্তে মিঠা পানি পাওয়া যায়। যা মূলত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক স্তরের সাথে সম্পর্কিত। সমুদ্রের লোনা পানির তুলনায় বৃষ্টির পানি হালকা হওয়ায় তা মাটির ওপরের স্তরে লেন্স আকারে জমা থাকে। জোয়ারের সময় এই মিঠা পানির স্তর লোনা পানির চাপে কিছুটা উপরে উঠে আসে, যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বা বন্যপ্রাণীরা গর্ত খুঁড়ে সেই পানি সংগ্রহ করতে পারে। তবে সব চরে বা সব সময় এই পানি পাওয়া যায় না।

সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার ৬৬ ভাগ রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ ৩৪ ভাগ রয়েছে ভারতের মধ্যে।

সুন্দরবনের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সেখানে গর্ত খুঁড়ে মিঠাপানি পাওয়া যায়।  সন্দরবনের চরে মাটির গর্তে মিঠাপানি পাওয়ার বিষয়টি একটি বিশেষ প্রাকৃতিক কৌশল, যা মূলত রেইনওয়াটার হারভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে।

সুন্দরবন ও উপকূলীয় কিছু কিছু চরে বালির স্তর ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। বৃষ্টির পানি বালির স্তরের মধ্য দিয়ে চুইয়ে নিচে জমা হয়। সুন্দরবন বা  বালুচরে মাটির কিছুটা গভীরে মিঠা পানি পাওয়া যায়। জোয়ারের নোনা পানি সরাসরি না ঢুকলে, মাটির গভীরে একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত বৃষ্টির পানি মিষ্টি থাকে।

সুন্দরবনের লোনা পরিবেশের মাঝে বনজীবীরা মৌয়াল, বাওয়ালী বা জেলেরা চরের মাটির গর্ত থেকে মিঠা পানি সংগ্রহের জন্য একটি প্রাচীন ও প্রাকৃতিক কৌশলের ওপর নির্ভর করেন। জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার পর বনজীবীরা সমুদ্র উপকূলের বালুচরে বা নদীর পাড়ে গভীর গর্ত করেন। মাটির স্তরে প্রাকৃতিকভাবে ফিল্টার হয়ে আসা চুইয়ে পড়া এই পানি শুরুতে কিছুটা ঘোলা থাকলেও থিতিয়ে নিলে তা পানযোগ্য হয়। প্রাচীনকাল থেকে সুন্দরবনেরে উপর নির্ভরশীল বনজীবীরা প্রাকৃতিক কৌশলে লবনাক্ত বালুচরের গর্ত থেকে মিস্টি পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করে।

সুন্দরবনের অনেক স্থানে বন বিভাগ এবং স্থানীয়রা বড় গর্ত বা পুকুর খনন করা হয়েছে। বর্ষাকালে এই গর্তগুলো বৃষ্টির পানিতে ভরে যায়। যেহেতু সুন্দরবনের নিচের স্তরের পানি লবণাক্ত, তাই এই বৃষ্টির পানিই পশুপাখি এবং মানুষের একমাত্র ভরসা। বাঘ, হরিণসহ বনের প্রাণীদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বন বিভাগ বিভিন্ন এলাকায় কৃত্রিমভাবে গর্ত বা পুকুর খনন করে দেয়। বৃষ্টির পানি এসব গর্তে জমা হয়ে থাকে, যা সারাবছর প্রাণীদের পানির চাহিদা মেটায়। শুষ্ক মৌসুমে যখন বৃষ্টি কম হয়, তখন বাষ্পীভবন এবং চারপাশের লবণাক্ত পানির চাপে অনেক সময় গর্তের পানিও কিছুটা নোনা হয়ে যায়। তাই বর্ষার বৃষ্টির পানি ধরে রাখাই এখানে মিঠাপানির প্রধান উপায়।

সুন্দরবনের চরে মাটির গভীরে মিঠা পানির বড় ভান্ডার আছে, যা হাজার বছরের পুরোনো এবং লবণাক্ত পানির নিচে সংরক্ষিত।  অগভীর স্তর লবণাক্ত এবং ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন, ঘূর্ণিঝড় ও  লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ  সুন্দরবনের মিঠা পানির উৎসকে সংকটে ফেলছে, বিশেষত গ্রীষ্মকালে। বিজ্ঞানীরা মাটির গভীরে বিশাল প্যালিওওয়াটার  বা প্রাচীন পানির ভান্ডারের সন্ধান পেয়েছেন, যা এই অঞ্চলের মানুষ ও বন্যপ্রাণীর জন্য সুপেয় পানির একটি বড় উৎস হতে পারে।

২০২৫ সালে  গবেষকরা সুন্দরবনের পশুর নদীর তীর ও তলদেশের মাটির গভীরে দুটি বিশাল মিঠা পানির জলাধারের  সন্ধান পেয়েছেন। এগুলোকে প্যালিওওয়াটার বা প্রাচীন পানি বলা হয়, যা হাজার বছর আগে জমা হয়েছিল এবং মাটির শক্ত স্তরের কারণে নোনা পানির সাথে মিশতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মেক্সিকো ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা খুলনা শহর থেকে সুন্দরবনের ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আধুনিক ভূ-তড়িৎ-চৌম্বকীয় প্রযুক্তি, ম্যাগনেটোটেলুরিক ব্যবহার করে ভূগর্ভের অভ্যন্তরীণ গঠন পরীক্ষা করেন। গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খুলনার উত্তরের অংশে প্রায় ২০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরে বিস্তৃত আছে বিশাল এক মিঠাপানির স্তর। এটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং পানির লবণাক্ততা এত কম যে সরাসরি মিঠাপানি হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে।

প্রাচীন পানির উৎস প্লাইস্টোসিন যুগের, প্রায় ১৫ থেকে ২৯ হাজার বছর পুরোনো, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কম থাকাকালীন জমা হয়েছিল। মিহি কাদা এবং শক্ত মাটির একটি স্তর উপরের লবণাক্ত পানি থেকে এই মিঠা পানির ভান্ডারকে আলাদা করে রেখেছে, যা একে অক্ষত রেখেছে। সুন্দরবনের নিচে আর ১ ও আর ২ নামে দুটি প্রধান মিঠা পানির স্তর শনাক্ত করা হয়েছে, যা ২০০ থেকে ৮০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।

সুন্দরবনের চরের গভীরে মাটির নিচে প্রাচীন মিঠা পানির বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে, যা হাজার হাজার বছর আগে শেষ বরফ যুগের সময় জমা হয়েছিল এবং যা উপরের লোনা পানির স্তর দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত। আন্তর্জাতিক গবেষকরা এটি আবিষ্কার করেছেন এবং এটি উপকূলীয় অঞ্চলের পানির সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তবে এটি খুব ধীরে রিচার্জ হয় বলে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত।

লবণাক্ততা ও আর্সেনিকের কারণে পানির সংকটে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি সুপেয় পানির একটি বড় উৎস হতে পারে। এই প্রাচীন মিঠা পানির ভান্ডার সংরক্ষণ করা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ