শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

SW News24
মঙ্গলবার ● ৩১ জানুয়ারী ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » জলাভূমি বাংলাদেশের প্রাণ
প্রথম পাতা » মুক্তমত » জলাভূমি বাংলাদেশের প্রাণ
২২২ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ৩১ জানুয়ারী ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

জলাভূমি বাংলাদেশের প্রাণ

প্রকাশ ঘোষ বিধান   ---

পরিবেশ ও জীববৈচিত্রে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম।পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে জলাভূমি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবছর ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় জলাভূমি দিবস। বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়। মানুষ ও পৃথিবীর প্রতি জলাভূমির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্রে জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জলাভূমির আন্তর্জাতিক উপযোগিতার কথা তুলে ধরা হয়েছিল এবং জলাভূমি বিষয়ে চুক্তি সাক্ষর হয়। ১৯৭৫ সালে সেই চুক্তি কার্যকর হয়। জলাভূমি সংক্রান্ত সম্মেলনে সাক্ষর গ্রহণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতেই এ দিবসটি পালন করা হয়। এখন পর্যন্ত ১৭১টি দেশ জলাভূমি বিষয়ে চুক্তি অনুমোদন করেছে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে ।

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষায় সম্মিলিত প্রয়াসের নামই হলো রামসার। ১৯৭১ সালে ইরানের ‘রামসার’ নগরে প্রথম বিশ্বের পরিবেশবাদীদের কনভেনশনের ‘অন ওয়েটল্যান্ডস’ নামক একটি সমঝোতা স্মারক করলে ১৫৮টি দেশ স্বাক্ষর করে এবং পৃথিবীর ১৬৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে ১ হাজার ৯২৮টি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিকে চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় রামসার সাইট হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওর।

রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত, ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট জলাভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালে টাংগুয়ার হাওরকে সুন্দরবন এর পর বাংলাদেশের ২য় রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এটি বিশ্বের বৃহত্তর জলাভূমি। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাহারি গাছপালা, বন্য পশু-পাখি ও জীবজন্তু ঘেরা এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত। জীববৈচিত্রের আধার সুন্দরবনে এখন ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি ও ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া আছে।

জীববৈচিত্র্য ও নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসিম। সুন্দরবনের প্রতিরোধ ও উৎপাদনমূলক ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি সমৃদ্ধি ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা পাচ্ছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব থেকে উপকূলীয় এলাকার রক্ষায় সুন্দরবন প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদরাজি বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড চুষে নেয়। বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখে। সুন্দরবনের কার্বন মজুদের পরিমাণ ২০০৯ সালের ১০৬ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে ১৩৯ মিলিয়ন টন হয়েছে।

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন  ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার-যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ ভাগ। ২৪ ঘণ্টায় ২ বার সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে। মোট আয়তনের ৬৮ দশমিক ৮৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪২ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে স্থলভাগ। সংরক্ষিত এই বনের ৩টি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণা করে। বর্তমানে যা সমগ্র সুন্দরবনের ৫২ ভাগ এলাকা। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার, যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। মানুষের বেঁচে থাকার এক অনন্য মৌলিক উপাদান অক্সিজেন, যার অন্যতম ভান্ডার সুন্দরবন।  প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ফলে বিশ্বে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। সুন্দরবনকে ঘিরে অর্থনীতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়া দূষিত হচ্ছে সেখানকার পানি, বায়ু ও মাটি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষের আগ্রাসনে গত ২০ বছরে ঘন বনের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। মানুষের ক্রামবর্ধমান ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে বন, বৃক্ষ ও বৈচিত্র্য রক্ষা হচ্ছে।

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর মিঠাপানির বিশাল এক জলরাশি। হাওরকন্যা খ্যাত এ হাওর মৎস্য উৎপাদন, কৃষিতে সেচ, বিনোদন, সর্বোপরি পরিবেশ ও ভূমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষায় করে চলেছে,  এ পানির উৎসব যেন ‍প্রকৃতির এক বিশাল আশীর্বাদ। উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা-সংরক্ষণে টাঙ্গুয়ার হাওরের ভূমিকা অতুলনীয়। টাঙ্গুয়ার হাওর ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জে হিমালয়ের পাদদেশে প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির এ জলাভূমি।

বাংলাদেশকে বলা হয় নদী মাতৃক দেশ। নদী-নালা,খাল-বিল হাওর, বাওড় এর মত বহু জলাভূমি ঘিরে রেখেছে এদেশকে। বাংলা পিডিয়ার তথ্য মতে, এদেশের ৭-৮ লক্ষ হেক্টর ভূমি কোন না কোনভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। যা আমাদের দেশের  মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ। আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জলাভূমি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশে দুটি রামসার সাইট সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর আছে। এর মোট আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১১২ বর্গকিলোমিটার। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ দুটি জলাভূমি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, নানা প্রজাতির স্তন্যপায়ী, মেরুদ্ণ্ডী, সরীসৃপ, মাছ ও পাখির আবাসস্থল।

পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস ও পর্যটন সহ নানা ক্ষেত্রে  এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হল জলাভূমি। এদেশের প্রাকৃতিক স্বাদু পানির মাছের প্রধান উৎস হল হাওর বেসিন অঞ্চল। জীববৈচিত্র্য এর ক্ষেত্রে এদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হল সুন্দরবন ও হাওড় অঞ্চল। এছাড়া আড়িয়াল বিল ও চলন বিল এদেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী হাওর বেসিন অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ৫.২৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের সংবিধান এর ১৮ক এর অনুচ্ছেদ এ পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এর কথা বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। যা সরকারের পরিবেশ বান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

লোনাপানি, স্বাদুপানি ও মানবসৃষ্ট অথবা আবদ্ধ জলরাশি ও উন্মুক্ত জলরাশি হিসেবেও জলাভূমিগুলোকে ভাগ করা যায়। ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্লাবনভূমি সংশ্লিষ্ট জলাভূমি, যেখানে বিল ও বাওড়ের অবস্থান; ২. ভূগাঠনিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট জলাভূমি, তা মূলত হাওর সমৃদ্ধ এবং বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অবস্থিত এবং ৩. উপকূলীয় এলাকার জলাভূমি। এ ছাড়া মানবসৃষ্ট বা কৃত্রিম জলাভূমি যথা- পুকুর, দিঘি ও লেক প্লাবনভূমির সবর্ত্র ছড়িয়ে আছে। চলনবিল, আত্রাই বিল, ভাটির পুনর্ভবা প্লাবনভূমি, গোপালগঞ্জ,খুলনা ডাকাতিয়া বিল, আরিয়ল বিল ও সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবনভূমি এবং কাপ্তাই হ্রদ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জলাভূমি।

১৭ শতক থেকে পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ জলাভূমির অস্তিত্বের বিপর্যয় ঘটে চলেছে। বনভূমির চেয়ে তিনগুণ হারে জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হারিয়ে যাওয়া থেকে জলাভূমি রক্ষা এবং সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করায় জাতীয় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে সচেষ্ট হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশকে ঘিরে রেখেছে। জীববৈচিত্র্য সহ খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে এই জলাভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের প্রাণ এই জলাভূমি। তাই নদী, নালা, হাওর বাওড় এর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এর কোন বিকল্প নেই।

লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)