

শুক্রবার ● ২৮ জুলাই ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক
প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক
প্রকাশ ঘোষ বিধান :
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি ১৮৬১ সালের ২রা আগষ্ট বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার রাড়ুলী ইউনিয়নের রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। এই মহান মানুষটি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, যিনি পি সি রায় নামে পরিচিত। পি সি রায় শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেননা। তিনি ছিলেন একজন শিল্পাদ্যোক্তা, সমাজ সংস্কারক, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক, কবি, শিক্ষানুরাগী, ব্যবসায়ী ও বিপ্লবী দেশপ্রেমিক। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে আমি বৈজ্ঞানিকের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম্য সেবকদের সাথে গ্রাম সেবক আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ। দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যখন যা প্রয়োজন, সেটাই তিনি করেছেন।
বাবা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন স্থানীয় জমিদার। তাঁর মায়ের নাম ভূবনমোহিনী দেবী। বাবা তাঁকে ডাকতেন ফুলু বলে। ছোটবেলায় মায়ের নিকট শিক্ষার হাতেখড়ি, পরে পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। চার বছর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। বাবার আগ্রহে ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন কিন্তু রক্ত আমাশয়ের কারণে তাঁর পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। এই ফিরে আসা তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে উঠে। এই সময় পিতা হরিশ চন্দ্র রায়ের লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করে পৃথিবীর জ্ঞান ভান্ডারের সন্ধান পান। পি সি রায়ের পৈতৃক নিবাস ১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র আবার কলকাতায় ফিরে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে এফ এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এখানে তিনি বি এস সি পাশ করেন এবং ডি এস সি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো অন পিরিয়ডিক ক্লাসিফিকেশন অফ এলিমেন্টস। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং ১৮৮৭ সালে পি এইচ ডি ও ডি এস সি ডিগ্রী লাভ করেন। তার গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হওয়ায় তাকে ১০০ পাউন্ড হোপ প্রাইজ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৮৮৮ সালে দেশে ফেরেন পি সি রায়। পরের বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর শিক্ষক, গবেষকজীবন ও বিভিন্ন সামাজিক কাজ। ঘি, সরিষার তেল ও বিভিন্ন ভেষজ উপাদান নিয়েই তিনি প্রথম গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেন। যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তাঁর অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। এ ছাড়া পারদ-সংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতু আবিষ্কার করে তিনি রসায়নজগতে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। গবাদি পশুর হাড় পুড়িয়ে তাতে সালফিউরিক এসিড যোগ করে তিনি সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি করেন। তার প্রথম মৌলিক গবেষণা খাবারে ভেজাল নির্ণয়ের রাসায়নিক পদ্ধতি উদ্ভাবন-সংক্রান্ত। ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট প্রতিনিধি হিসাবে তৃতীয়বারের মত তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সিআইই লাভ করেন। ১৮৮৯ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। এরপর ১৯৩৬ সাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৩৭ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি যখন পরিপূর্ণ অবসর নিতে চাইলেন, তখন তাকে আমৃত্যু অধ্যাপক হিসেবে রসায়নের গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। এ ছাড়া একই বছর লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত বর্ষের মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ১৮৮৫ সালে সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে এবং ভারতবিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
পি সি রায় ১২০০ শতাব্দী এবং তারও পূর্বের ভারতবর্ষের রসায়ন চর্চার ইতিহাস তুলে ধরে প্রমাণ করেন যখন ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ গাছের ছাল বা বাকল পরে লজ্জা নিবারণ করতো, তখন ভারতবর্ষের মানুষ পারদের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত ছিলো। বিজ্ঞানের উপর ১৫০ গবেষণা গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন র্জানাল মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে। পি সি রায় ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্রদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। তিনি ছিলেন চিরকুমার। ছাত্রছাত্রীরাই ছিল তার ছেলে মেয়ে। তিনি বুঝেছিলেন বাংলায় বক্তৃতা ছাত্রদের অনুধাবনের পক্ষে সহায়ক। তাই ক্লাসে বাংলায় বক্তৃতা দিতেন এবং পড়ার সময় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও বিখ্যাত বাক্তিদের জীবনকাহিনী এবং তাদের সফলতার কথা তুলে ধরতেন। তার বাচনভঙ্গী ছিল অসাধারণ, তিনি ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন খুব সহজেই। বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিয়ে তিনি কলেজেরই দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি ঘরে থাকতেন। ছাত্ররাই তার দেখাশুনা করতো। যেসব ছেলেরা তারকাছে থাকত, তাদেরই একজনের হাতে মাথা রেখে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর, পুলিন বিহারী সরকার, রসিকলাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, প্রিয়দা ভঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জি প্রমূখ। একবার ফজলুল হক ৫/৬ দিন ক্লাসে না আসলে একদিন বিকালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় তার বাসায় যান। ফজলুল হক তখনও খেলার মাঠে থাকায় তিনি তার জন্য অপেক্ষা করেন। ফজলুল হক ফিরে এসে স্যারকে দেখে তিনি কতক্ষণ এসেছেন জানতে চাইলে বলেন ‘তোমাদের হিসেবে এক ঘন্টা আর আমার হিসেবে ষাট মিনিট’। বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি প্রফুল্লচন্দ্র তার ছাত্রদের নৈতিক স্বাদেশিক শিক্ষাতেও দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের বলতেন, গরীব মানুষের পয়সায় লেখাপড়া শিখছো, এদের ঋণের বোঝা কিন্তু একদিন ফিরিয়ে দিতে হবে।ছাত্রদের নিয়ে তিনি বন্যা মহামারী দুর্ভিক্ষ- সব সময়ই আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
তিনি শিল্প-রসায়ন ও ভারতীয় রসায়নের জনক। খুব সাদামাটা জীবন ছিল তাঁর। জমিদার বংশের সন্তান হয়েও তাঁর সাদাসিধে জীবনযাপন দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যেতেন। কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের একটি কক্ষ। আসবাবপত্রের মধ্যে একটি খাটিয়া, দুটি চেয়ার, ছোট একটি খাবার টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও জামাকাপড় রাখার একটি সস্তা আলনা। পড়নে থাকত কম দামের মোটা খোটা ধুতি, চাদর, গেঞ্জি অথবা গায়ে একটি কোট। এক রাশ দাড়িগোফ মুখে লোকটির চুলে বোধকরি চিরুনি পড়েনি। সকালে মাত্র এক পয়সার নাস্তা। এক পয়সার বেশি নাস্তা হলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। অন্যান্য খাবারদাবারও খুব সাদামাটা। অথচ তখন মাসিক আয় হাজার টাকার উপরে। মোট আয় থেকে নিজের জন্য মাত্র ৪০ টাকা রেখে বাকি সব দান করে দিতেন।
১৯১৫ সালে কুদরত-ই খুদা (একমাত্র মুসলিম ছাত্র) এমএসসি তে (রসায়ন) প্রথম শ্রেণি পাওয়ায় কয়েকজন হিন্দু শিক্ষক তাকে অনুরোধ করেন প্রথম শ্রেণি না দেওয়ার জন্য। অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও পিসি রায় নিজের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুদরত-এ-খুদাকে প্রথম বিভাগ দেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন তার অতি প্রিয় ছাত্র।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট