শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২

SW News24
বুধবার ● ২৯ অক্টোবর ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » রাসপূর্ণিমার আধ্য়াত্মিক তাৎপর্য
প্রথম পাতা » মুক্তমত » রাসপূর্ণিমার আধ্য়াত্মিক তাৎপর্য
২৫ বার পঠিত
বুধবার ● ২৯ অক্টোবর ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

রাসপূর্ণিমার আধ্য়াত্মিক তাৎপর্য

---রাসপূর্ণিমা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই তিথি তথা দিন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রাস পূর্ণিমা নিছক একটি উদযাপন নয় বরং একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা যা গভীর শিক্ষা দেয়। এটি ভক্তদের অটল প্রেম, নিঃস্বার্থ ভক্তি এবং ঐশ্বরিক আত্মসমর্পণের গুরুত্ব শেখায়। রাস লীলা হল জীবনের চিরন্তন নৃত্যের রূপক, যেখানে ব্যক্তিরা বস্তুগত জগতের বাধা অতিক্রম করে ঈশ্বরের সাথে মিলন মাধ্যম খোঁজে।

সনাতন ধর্মালম্বীদের একটি বাৎসরিক উৎসব হলো রাসলীলা বা রাসযাত্রা। রাস মূলতঃ শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব। ভগবান কৃষ্ণের রসপূর্ণ অর্থাৎ তাত্ত্বিক রসের সমৃদ্ধ কথাবস্তুকে রাসযাত্রার মাধ্যমে জীবাত্মার থেকে পরমাত্মায়, দৈনন্দিন জীবনের সুখানুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় এবং কামপ্রবৃত্তিসমূহকে প্রেমাত্মক প্রকৃতিতে রূপ প্রদান করে অঙ্কন করা হয়েছে।

রাস পূর্ণিমা ভগবান কৃষ্ণের ঐশ্বরিক খেলা এবং এটি যে নিরন্তর পাঠ দেয় তার একটি প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। এটি প্রেম,ভক্তি ঈশ্বর এবং ভক্তের মধ্যে চিরন্তন সংযোগের উদযাপন। ভক্তরা উৎসবে নিজেদের নিমজ্জিত করার সাথে সাথে, তারা ঐশ্বরিক প্রেমের অতীন্দ্রিয় প্রকৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তাদের ধার্মিকতা এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পথে চলতে অনুপ্রাণিত করে। রাস পূর্ণিমা সকলকে জীবনের স্বর্গীয় নৃত্যে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, ভক্তির মহিমা এবং ঐশ্বরিক মাহাত্মকে আলিঙ্গন করে।

শ্রী কৃষ্ণ ইহ জগতে আবির্ভূত হওয়ার পর শ্রীক্ষেত্র বৃন্দাবনে দিব্যলীলা বিলাস করছিলেন। তখন শ্রী কৃষ্ণের বয়স আট বছর। শ্রীকৃষ্ণ পুর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের কুঞ্জে মধ্য রাতে তাঁর অপ্রাকৃত বংশী ধ্বনি দ্বারা তাঁর প্রিয়  ভক্ত গোপীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তখন সেই রাতে শ্রীকৃষ্ণের বংশী ধ্বনি শোনবার পর, ব্রজ গোপীরা গৃহ থেকে বেরিয়ে পড়েন। তারা সকলে কৃষ্ণের কাছে ছুঁটে গিয়েছিলেন। কেবল বৃন্দাবনের গোপীরাই নয়, ব্রহ্মান্ডের বিভিন্ন স্থান থেকে ভগবানের কাছে সকলেই ছুটে গিয়েছিলেন। নিত্যসিদ্ধ এবং সাধনসিদ্ধ সকলকে তিনি সেদিন আহ্বান করেছিলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ আগত সকল গোপীদের সাথে নিজেকে  বিস্তার করে সকলের সাথে নৃত্য করেছিলেন। বৃন্দাবনের এই  নৃত্যই রাসনৃত্য বলে সুপরিচিত।

রাস শব্দটি এসেছে রস থেকে। রস হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে মাধুর্য রস। মাধুর্য রসে কৃষ্ণ এই লীলা করেছিলেন বলে এর নাম রাসলীলা। এই লীলা ভগবানের সব থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ লীলা এবং চিন্ময় স্তরের সর্বোচ্চ উপলব্ধি। রাসলীলায় ছিলেন তিন শ্রেণির গোপী নিত্যসিদ্ধা,সাধনসিদ্ধা ও কৃপাসিদ্ধা। এছাড়া, সংস্কৃত শাস্ত্রে রাস শব্দটির আরও অনেক অর্থ রয়েছে, যেমন - আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, প্রেম, বা বিভিন্ন শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা ও নাটকের ভিত্তি।

রাস পূর্ণিমার কেন্দ্রস্থলে গোপীদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মোহনীয় নৃত্য, যা রাসলীলা নামে পরিচিত। বৈষ্ণব পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এই দিব্য রাতে, ভগবান কৃষ্ণ বৃন্দাবনের চন্দ্রালোকিত মায়াবী রাতে তাঁর সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে গোপীদের হৃদয়কে মোহিত করেছিলেন। ঐশ্বরিক সঙ্গীত দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে, গোপীরা কৃষ্ণের প্রতি অপ্রতিরোধ্যভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং একসাথে,তারা নিষ্কাম প্রেমের স্বর্গীয় নৃত্য,রাস লীলায় নিযুক্ত হয়েছিল।

রাসলীলা শুধু শারীরিক নৃত্যে নয়; এটি পরমাত্মা এর সাথে  জীবাত্মার মিলনের প্রতীক। গোপীরা ভক্তদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং কৃষ্ণের প্রতি তাদের অটল ভালবাসা শুদ্ধ, নিঃস্বার্থ ভক্তির ইঙ্গিত দেয়। রসলীলা ভক্তদেরকে ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ রূপে আত্ম সমর্পণ করতে শেখায়, সেই আনন্দময় মিলনের অভিজ্ঞতা লাভ করে যা বস্তু জগতকে অতিক্রম করে।

মণিপুরিদের সব থেকে বড় উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরণ বা রাসপুর্ণিমা নামের মণিপুরিদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে আনুমানিক ১৮৪৩ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পুর্ণিমা তিথিতে দুরদুরান্তের লক্ষ লক্ষ ভক্ত-দর্শক মৌলবীবাজার জেলার সিলেটের কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামণ্ডপের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষণে ছুটে আসেন। রাসপূর্ণিমায় রাসলীলা উৎসবের শুরুটা হয় গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য দিয়ে। এ নৃত্য হয় সকালে। যারা রাখাল নৃত্য করে, তারা প্রথমে মণ্ডপে গোল হয়ে গোপী ভোজন করে। গোপী ভোজন হল বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারি ও ভাত। এ খাবার খেয়েই রাখাল নৃত্য শুরু করে শিল্পীরা।

কথিত আছে, মনিপুরের আদিবাসী রাজা রাজর্ষী ভাগ্যচন্দ্র একদিন স্বপ্নে দেখতে পান রাধা ও কৃষ্ণের লীলা। তারপর তিনি স্বপ্নের আলোকেই উপস্থাপন করেন রাসলীলার রাসনৃত্য। তিনি কয়েকজন কুমারী মেয়ে দিয়ে স্বপ্নের মতো রাসলীলা করান। তার নিজ মেয়ে কুমারী বিশ্বাবতীকে শ্রীরাধা এবং মন্দিরের শ্রীগোবিন্দকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাসলীলা করেন এবং তিনি নিজেই ওই রাসে মৃদঙ্গবাদক ছিলেন। তাতে তিনি নিজস্ব তাল ব্যবহার করেন। তার সে তালই এখন পর্যন্ত চলছে। অন্য সুত্র থেকে জানা যায়, ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেন তা-ই রাসনৃত্য। মহারাজার মৃত্যুর একশ বছর পরে মহারাজ চন্দ্রকীর্তির শাসনামলে গোটা রাসনৃত্য আচৌকা, বৃন্দাবন, খুডুম্বা, গোস্ট, গোস্ট বৃন্দাবন, আচৌবা বৃন্দাবনসহ নানা ভঙ্গির পর্যায়ে পড়ে।

মণিপুরিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তলোয়ার নৃত্য, মশাল নৃত্য, মার্শাল আর্ট, নাচ, ঢোলক নৃত্যসহ বিভিন্ন নাচ-গান উপস্থাপন করে। মণিপুরিদের উৎসব কেবল আর মণিপুরিদের মধ্যে নেই। এই উৎসবটি এখন ওই এলাকায় সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। সিলেট ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস উৎসব হয়। উপকুল এলাকায় সুন্দরবনের দুবলার চর আলোর কোল ঘেষে রাস পূর্ণিমায় পুজা ও মেলা বসে। সাগর দুহিতায় প্রচুর পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটে।

রাস পূর্ণিমা, একটি স্বর্গীয় উদযাপন যা বৈষ্ণব ঐতিহ্যে অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। কার্তিক মাসের পূর্ণিমার রাতে এই উৎসব পালিত হয়। রাস পূর্ণিমা একটি আনন্দদায়ক উপলক্ষ যা বৃন্দাবনের পবিত্র ভূমিতে গোপীদের সাথে ভগবান কৃষ্ণের ঐশ্বরিক নৃত্যকে চিহ্নিত করে। এই শুভ রাত্রিটি কেবল একটি স্বর্গীয় দর্শনই নয় বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা যা প্রেম,ভক্তি এবং ঐশ্বরিক এবং ভক্তের মধ্যে চিরন্তন সংযোগ স্থাপন করে।





আর্কাইভ