

শনিবার ● ১৯ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » দাবা খেললে মানসিক ক্ষমতার বিকাশ ও মন শাণিত হয়
দাবা খেললে মানসিক ক্ষমতার বিকাশ ও মন শাণিত হয়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
দাবা খেলা মানুষের মানসিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটায়। দাবা খেলা দুটি খেলোয়াড়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্তি এবং সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ন্যায্যতা প্রচার করে। প্রাচীনকালে দাবা খেলা ছিল বিনোদন ও রাজকীয়তার খেলা। এই খেলাটি বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা এবং শিল্পের উপাদানগুলির সমন্বয়ে সবচেয়ে প্রাচীন বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক খেলা। দাবা খেললে মনও শাণিত হয়।
প্রতি বছর ২০ জুলাই বিশ্ব দাবা দিবস পালিত হয়। দাবা খেলাটি হলো এমন একটি বুদ্ধির খেলা, যার উৎপত্তি ভারতে। বহু প্রাচীনকাল থেকে এই খেলাটি খেলা হয়ে থাকে। কখনও পাশা নামে, কখনও দাবা নামে এই খেলাটি পরিচিত হয়েছে। কৌশলগত চিন্তাভাবনা বৃদ্ধি করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো দাবা। দাবার মাধ্যমে যাতে জ্ঞানের দক্ষতা আরও বেশি বাড়ানো যায়, সেই উদ্দেশ্যেই প্রতি বছর পালন করা হয় বিশ্ব দাবা দিবস।
বেশির ভাগ ঐতিহাসকগণই মনে করেন যে প্রাচীণ ভারতবর্ষেই দাবা খেলার জন্ম। ঠিক কোথায় সর্বপ্রথম দাবা খেলার উৎপত্তি, সেটি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে গুপ্ত রাজবংশের সময় ভারতে প্রথম এই খেলাটির উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে এই খেলাটি চতুরঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। দাবার এই প্রাচীন সংস্করণটি পারস্য সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই সমস্ত জায়গায় এটি শতরঞ্জ নামে পরিচিত হয়।
দাবা খেলার জন্ম ভারতবর্ষে বলে সর্বাধিক প্রচলিত মতবাদ। এছাড়া, পারস্য বর্তমান ইরান দেশে ৩য় শতাব্দীতে প্রচলিত শতরঞ্জ এবং চীনে ২য় শতাব্দীতে প্রচলিত শিয়াংছী নামক খেলাকে দাবার পূর্বসূরী হিসেবে গণ্য করার পক্ষেও মতামত আছে। কথিত আছে যে রাবনের স্ত্রী মন্দোদরী যুদ্ধে নিবৃত করার জন্য রাবনের সাথে দাবা খেলতেন। পুরাণ অনুযায়ী রাবনের স্ত্রী মন্দোদরী এই খেলা আবিস্কার করেন। প্রাচীন ভারতীয় খেলা হিসেবে দাবার সংস্কৃত শব্দ শতরঞ্জ খেলাটি পরিবর্তিতরূপে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ক্রীড়াবিদেরা দাবার কৌশল এবং বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে খেলাটির ধারাই পরিবর্তন করে দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক দাবা দিবস উদযাপন করার তাৎপর্য হলো এই খেলাটিকে বৃহত্তর জনসাধারণের মাঝে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা। গবেষণায় দেখা যায়, এই খেলাটি শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের স্মৃতিশক্তি, একাগ্রতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতা উন্নতি করে। শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটানোর জন্য এই দাবা খেলা ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
২০ জুলাই বিশ্ব দাবা দিবস। ১৯২৪ সালের এই দিনে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে বিশ্ব দাবা সংস্থা গঠন করা হয়েছিলো। খেলাটির প্রচার এবং প্রসারের উদ্দেশ্যে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ২০ জুলাই প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে দাবা দিবস পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছর বিশ্ব দাবা সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে। এই দিন বিশ্ব দাবা সংস্থার ১৮১টি সদস্য স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তঃজাতিক পর্যায়ে দাবা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করে।প্রথম দাবা দিবস ১৮৫১ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা জার্মানির অ্যাডলফ অ্যান্ডারসেন জিতেছিলেন।
আগে চতুরঙ্গ নামে পরিচিত দাবা খেলাটি ভারতীয় পাশা খেলার সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন নিয়মে খেলাটি প্রচলিত ছিল। ইউরোপে গত একশ বছরে দাবার বিভিন্ন আইনকানুনের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে এ খেলাকে সর্বসাধারণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তোলা হয়। এ বিবর্তনের পথ ধরে দাবাকে ঘিরে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা যার প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থার সদস্য এবং তারা খেলার আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন মেনে চলে।
দাবা একটি জনপ্রিয় খেলা যা বোর্ড বা ফলকের উপর খেলা হয়। যিনি দাবা খেলেন তাকে দাবাড়ু বলা হয়। দাবায় দুই জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করে। দাবা ১৬টি করে গুটি দ্বারা ৬৪ বর্গক্ষেত্রের একটি বোর্ডে দুইজন খেলোয়াড়ের খেলা। এ ১৬টি গুটির ১টি রাজা, ১টি মন্ত্রী, ২টি ঘোড়া, ২টি হাতি, ২টি নৌকা ও ৮টি বোড়ে (সৈন্য) থাকে। দাবা মূলত রাজার খেলা বা রাজায় রাজায় যুদ্ধের খেলা। এ খেলা হয়ে থাকে দুই দলের রাজার মধ্যে। এক রাজাকে কিস্তি দেওয়া বা আক্রমণ করাই অন্য রাজার উদ্দেশ্য। অনেক স্থানে এ খেলাকে কিস্তিমাত খেলাও বলা হয়। যেকোনো উপায়ে রাজাকে বন্দি করাই হলো দাবা খেলার মূল লক্ষ্য। খেলতে খেলতে যে দলের রাজা কিস্তির ফাঁদে আটকা পড়ে বা বন্দি হয়ে যায় সেই রাজার দল পরাজিত হয়।
প্রথমদিকে দাবা ছিলো রাজাদের খেলা। এরপর সাধারণত উচ্চ শ্রেণির মানুষদের মধ্যেই এই খেলা সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু আধুনিক যুগে এই খেলাটি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮৫১ সালে লন্ডনে প্রথম আধুনিক দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিলো। এই প্রতিযোগিতায় জার্মানির দাবাড়ু অ্যাডলফ অ্যান্ডারসন জয় লাভ করেন।
প্রতিবছর বিশ্ব দাবা সংস্থা ফিডে বিভিন্ন কার্যসূচীর মাধ্যমে এই দিবস উদযাপন করে। আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার দাবা খেলার সর্বোচ্চ খেতাব যা দাবা খেলার আন্তর্জাতিক সংগঠন ফিডে কর্তৃক দেয়া হয়। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়া গ্র্যান্ডমাস্টার হলো একমাত্র খেতাব যা একজন দাবা খেলোয়াড় অর্জন করতে পারেন। একবার অর্জন করার পর আজীবন একজন খেলোয়াড় এই পদবীর দাবিদার থাকেন।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট