শিরোনাম:
পাইকগাছা, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

SW News24
রবিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » সুন্দরবন » বনজীবীর ছদ্দবেশে বনের সম্পদ লুণ্ঠনকারী চোরা শিকারীরা সুন্দরবন ধ্বংস করছে
প্রথম পাতা » সুন্দরবন » বনজীবীর ছদ্দবেশে বনের সম্পদ লুণ্ঠনকারী চোরা শিকারীরা সুন্দরবন ধ্বংস করছে
১৫ বার পঠিত
রবিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বনজীবীর ছদ্দবেশে বনের সম্পদ লুণ্ঠনকারী চোরা শিকারীরা সুন্দরবন ধ্বংস করছে

---প্রকাশ ঘোষ বিধান (খুলনা) পাইকগাছা ঃ  সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাকি দিয়ে অসাধু বনজীবীরা সুন্দরবনে প্রবেশ করে মাছ ও কাকড়া আহরণ করছে। তাও শুধু হাতে নয় রীতিমতো বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবন থেকে মাছ অহরহ করছে। বনজীবীর নামে তারাই প্রকৃত চোরা শিকারী ও বনের সম্পদ লুণ্ঠনকারী।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলজুড়ে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবন। রূপ-বৈচিত্র্যে ঘেরা, নানা প্রজাতির বনজ বৃক্ষের সমারোহে সাজানো নয়নাভিরাম এই বনভূমি উপকূলবাসীর প্রাকৃতিক রক্ষাকবজ। গত কয়েক বছরে একের পর এক সুপার সাইক্লোনের আঘাত সয়ে উপকূলের মানুষকে রক্ষা করছে সুন্দরবন। কিন্তু সেই মানুষই এখন এই বন ধ্বংস করছে নিজেদের স্বার্থে।

বনজীবী ও মৎস্যজীবীর ছদ্ধবেশে বনের সম্পদ লুণ্ঠনকারী এরাই ভঙ্কর শিকারী। বনবিভাগ সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তখন তারা অসহায় গরিব মানুষ হয়ে যায়,পেটের দায়ে বনে এসেছে এ অজুহাত দাড় করায়। এদের কারণে দিন দিন অস্থিত্ব সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে সুন্দরবন।

বনজীবী নামে অসাধু ব্যক্তিরা সুন্দরবনের নদী ও খালে অবাধে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, নেট জাল দিয়ে মাছের রেণু আহরণের মাধ্যমে ধ্বংস করা হচ্ছে নদীর প্রাণী। অনেক প্রজাতির মাছ এখন আর দেখায় যায় না। সুন্দরবনের নদীতে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় এসব মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। বিষ দেয়ায় মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা পড়ছে। বিষ দিয়ে মাছ ধরার পরে ওই খালে আর মাছ আসে না। চোরা শিকারিদের টার্গেট থেকে বাদ যাচ্ছে না বনের হরিণ ও বাঘও।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত সুন্দরবনে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে তিন মাসের জন্য সব নদ-নদী ও খালে মাছ ও মধু আহরণ বন্ধ এবং দেশী-বিদেশী পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে সুন্দরবন বিভাগ। বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবার অত্যন্ত তৎপর থাকায় পতিনিয়ত পশ্চিম সুন্দরবন ও পূর্ব সুন্দরবন থেকে অবৈধভাবে প্রবেশকারি ‌মাছ কাকড়া আহরণকারীদের আটক করে বন আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। বন বিভাগের এই সিদ্ধান্তে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলে, বনজীবী ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে তালিকাভুক্ত বনজীবীদের সরকারি ভাবে তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশে বহাল থাকবে। গোটা সুন্দরবনে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে গত ২৪ মে থেকে জেলে, মৌয়ালী ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, এই তিন মাস সুন্দরবনে মাছ কাঁকড়া ও বনপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম হিসেবে সরকার চিহ্নিত করেছে সে কারণে এই তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষিদ্ধ সময় আইন অমান্য করে যারা সুন্দরবনের প্রবেশ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ২০১৯ সাল থেকে বন বিভাগ প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত গোটা সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ রাখে। ২০২১ সালে দুই মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও ২০২২ থেকে তা আরো এক মাস বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ে সুন্দরবনে সব ধরনের পর্যটকের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়।

সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের অংশে জলভাগের পরিমাণ ১,৮৭৪.১ বর্গকিলোমিটার, যা সমগ্র সুন্দরবনের আয়তনের ৩১.১৫ শতাংশ। সুন্দরবনের জলভাগকে বলা হয় মৎস্য সম্পদের ভাণ্ডার। এই জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদামাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস মাছের প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশিরভাগ মাছের ডিম থেকে নতুন মাছ জন্ম নেয়। তাই এই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদসহ সব জীবের জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগ।

সুন্দরবন বিভাগ জানায়, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (আইআরএমপি) এর সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে বন বিভাগ প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ রাখে। গত ২০২২ সাল থেকে এই সময় আরও এক মাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করেছে মন্ত্রণালয়। এই তিন মাসে সমগ্র সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সুন্দরবনে প্রবেশের সব ধরণের পারমিট বন্ধ রাখা হয়েছে। এই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় নদী-খালে মাছ বৃদ্ধি পাবে।

সাতক্ষীরা সহকারী বন সংরক্ষক ফজলুল হক বলেন, এই তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের প্রবেশ অধিকার নিষিদ্ধ রয়েছে সরকারিভাবে। সে কারণে সুন্দরবনে কোন ভাবেই প্রবেশ করা যাবে না। তিনি আরো বলেন যে সমস্ত জেলেরা অবৈধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে তাদেরকে আটক করে আইনের আওতায় আনার জন্য বনবিভাগ সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত কোন না কোন অপরাধীকে আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। বনজীবীদের এই তিন মাস সংসার চালাতে একটু কষ্ট হচ্ছে, তাই  সরকারিভাবে তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের জারি করা নীতিমালা সবাইকে বাধ্যতামূলক পালন করতে হবে। সে কারণে বনজীবীদের এই তিন মাস কোন অপরাধ ক্ষমা করা যাবে না।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এই ম্যানগ্রোভবনে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের নদ-নদী ও খালে মাছ ও মধু আহরণ বন্ধসহ দেশী-বিদেশী সব পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এজন্য গত ২৪ মে থেকে জেলে, মৌয়ালী ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশের পারমিট দেয়া বন্ধ করেছে। এই তিন মাস সুন্দরবনে মাছ ও মধু আহরণসহ সব ধরনের পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সময়ে সুন্দরবনে কেউ যেতে পারবেন না। এই নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেই জেলে, মৌয়ালী ও সব পর্যটকদের সুন্দরবন থেকে বের করে আনা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সুন্দরবন সন্নিহিত লোকালয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রকৃতির এক অতুলনীয় রক্ষাকবচ ম্যানগ্রোভ বন। নদী-মোহনার কিনারে ছড়িয়ে থাকা সবুজ এই প্রাকৃতিক বেষ্টনী আমাদের অস্তিত্বেরও বড় ভিত্তি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূল রক্ষা, জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এর ভূমিকা অপরিসীম। এ যেন উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্য একপ্রকার জীবন্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এ বন সুরক্ষা করা অপরিহার্য। অথচ কিছু সংখ্যাক অসাধু বনজীবী ও চোরা শিকারী এই বনের অমূল্য সম্পদ লুণ্ঠন করে সুন্দরবনকে নানা হুমকির মুখে ফেলছে। উপকূল রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে সুন্দরবন বাঁচিয়ে রাখা অপরিহার্য। তাই প্রাকৃতিক এই রক্ষাকবচ সুন্দরবন সুরক্ষার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)