শিরোনাম:
পাইকগাছা, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২

SW News24
রবিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বনজীবীর ছদ্মবেশে চোরা শিকারিরা ধ্বংস করছে সুন্দরবন
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বনজীবীর ছদ্মবেশে চোরা শিকারিরা ধ্বংস করছে সুন্দরবন
১৫২ বার পঠিত
রবিবার ● ২৭ জুলাই ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বনজীবীর ছদ্মবেশে চোরা শিকারিরা ধ্বংস করছে সুন্দরবন

--- প্রকাশ ঘোষ বিধান

সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য বনজীবীর ছদ্মবেশে চোরা শিকারীরা তৎপর। তারা বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপের মাধ্যমে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাকি দিয়ে অসাধু বনজীবীরা সুন্দরবনে প্রবেশ করে মাছ ও কাকড়া আহরণ করছে। তাও শুধু হাতে নয় রীতিমতো বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবন থেকে মাছ অহরহ করছে। বনজীবীর নামে এরই প্রকৃত চোরা শিকারী ও বনের সম্পদ লুণ্ঠনকারী। চোরা শিকারিদের এই কার্যকলাপ বন্ধ করতে না পারলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সুন্দরবন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এটি পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানেগ্রোভ বন, যা জীববৈচিত্র্য, পরিবেশগত সুরক্ষা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিতে গুরুত্ব ভূমিকা রাখে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলজুড়ে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবন। রূপ-বৈচিত্র্যে ঘেরা, নানা প্রজাতির বনজ বৃক্ষের সমারোহে সাজানো নয়নাভিরাম এই বনভূমি উপকূলবাসীর প্রাকৃতিক রক্ষাকবজ। গত কয়েক বছরে একের পর এক সুপার সাইক্লোনের আঘাত সয়ে উপকূলের মানুষকে রক্ষা করছে সুন্দরবন। কিন্তু সেই মানুষই এখন এই বন ধ্বংস করছে নিজেদের স্বার্থে।

শিকারিদের মধ্যে কেউ কেউ প্রভাবশালী গডফাদারের ছত্রছায়ায় চলে। এসব গডফাদার বনের বাহিরে থেকে শিকারিদের নিযন্ত্রণ করে। বনজীবী ও মৎস্যজীবীর ছদ্ধবেশে বনের সম্পদ লুণ্ঠনকারী এরাই ভঙ্কর শিকারী। বনবিভাগসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তখন তারা অসহায় গরিব মানুষ হয়ে যায়, পেটের দায়ে বনে এসেছে এ অজুহাত দাড় করায়। এদের কারণে দিন দিন অস্থিত্ব সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে সুন্দরবন।

বনজীবী নামে অসাধু ব্যক্তিরা সুন্দরবনের নদী ও খালে অবাধে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, নেট জাল দিয়ে মাছের রেণু আহরণের মাধ্যমে ধ্বংস করা হচ্ছে নদীর প্রাণী। সুন্দরবনের নদীতে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় এসব মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। বিষ দেয়ায় মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা পড়ছে। নদী ও খালে অবাধে বিষ দিয়ে মাছ শিকার, মাছের পোনা ধরার মতো কার্যকলাপও চলছে, যা জলজ প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর। অনেক প্রজাতির মাছ এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে।

সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে, যা সেখানকার জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। চোরা শিকারিদের টার্গেট থেকে বাদ যাচ্ছে না বনের কোন প্রাণী। বিশেষ করে হরিণ শিকারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিত্রা হরিণের মতো সুন্দরবনের আকর্ষণীয় প্রাণীও এখন হুমকির মুখে পড়েছে। চোরা শিকারিরা শুধু হরিণ নয়, বাঘও শিকার করছে এবং তাদের মাংস ও চামড়া পাচার করছে।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত সুন্দরবনে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে তিন মাসের জন্য সব নদ-নদী ও খালে মাছ ও মধু আহরণ বন্ধ এবং দেশী-বিদেশী পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে সুন্দরবন বিভাগ।প্রতিবছরই ১জুন থেকে ৩১আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে এই নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে, যাতে জলজ প্রাণীরা নির্বিঘ্নে প্রজনন ও বংশবিস্তার করতে পারে। এ সময় সুন্দরবনের সকল প্রকার মাছ ধরা, কাঁকড়া আহরণ ও বনজ সম্পদ সংগ্রহ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ থাকে। বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবার অত্যন্ত তৎপর থাকায় প্রতিনিয়ত পশ্চিম সুন্দরবন ও পূর্ব সুন্দরবন থেকে অবৈধভাবে প্রবেশকারি ‌মাছ কাকড়া আহরণকারীদের আটক করে বন আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। বন বিভাগের এই সিদ্ধান্তে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলে, বনজীবী ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে তালিকাভুক্ত বনজীবীদের সরকারি ভাবে তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

সুন্দরবন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বনভুমি যা দেশের মোট সংরক্ষিত বন ভূমির ৪৪ শতাংশ। উপকূলের প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের অংশে জলভাগের পরিমাণ ১৮৭৪.১ বর্গকিলোমিটার, যা সমগ্র সুন্দরবনের আয়তনের ৩১.১৫ শতাংশ। সুন্দরবনের জলভাগকে বলা হয় মৎস্য সম্পদের ভাণ্ডার। এই জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদামাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস মাছের প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশিরভাগ মাছের ডিম থেকে নতুন মাছ জন্ম নেয়। তাই এই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদসহ সব জীবের জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সুন্দরবন বিভাগ জানায়, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (আইআরএমপি) এর সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে বন বিভাগ প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ রাখে। গত ২০২২ সাল থেকে এই সময় আরও এক মাস বাড়িয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করেছে মন্ত্রণালয়। এই তিন মাসে সমগ্র সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সুন্দরবনে প্রবেশের সব ধরণের পারমিট বন্ধ রাখা হয়েছে। এই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় নদী-খালে মাছ বৃদ্ধি পাবে।

সরকার এই নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে জেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। বনজীবীদের এই তিন মাস সংসার চালাতে একটু কষ্ট হচ্ছে, তাই  সরকারিভাবে তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের জারি করা নীতিমালা সবাইকে বাধ্যতামূলক পালন করতে হবে। এই নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেই জেলে, মৌয়ালী ও সব পর্যটকদের সুন্দরবন থেকে বের করে আনা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সুন্দরবন সন্নিহিত লোকালয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এই নিষিদ্ধ সময় আইন অমান্য করে যারা সুন্দরবনের প্রবেশ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বন বিভাগ।

শিকারিদের মনমানসিকতা পরিবর্তন না হলে বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করা কঠিন হবে। ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে শিকারিদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। যে সব শিকারি জেলের বেশ ধারণ করে সুন্দরবনে প্রবেশ করে পশু হত্যায় মেতে ওঠে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শিকারিদের যে সব গডফাদার রয়েছে তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে।

সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রকৃতির এক অতুলনীয় রক্ষাকবচ ম্যানগ্রোভ বন। নদী-মোহনার কিনারে ছড়িয়ে থাকা সবুজ এই প্রাকৃতিক বেষ্টনী আমাদের অস্তিত্বেরও বড় ভিত্তি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূল রক্ষা, জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এর ভূমিকা অপরিসীম। এ যেন উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর জন্য একপ্রকার জীবন্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এ বন সুরক্ষা করা অপরিহার্য। অথচ কিছু সংখ্যাক অসাধু বনজীবী ও চোরা শিকারী এই বনের অমূল্য সম্পদ লুণ্ঠন করে সুন্দরবনকে নানা হুমকির মুখে ফেলছে। উপকূল রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে সুন্দরবন বাঁচিয়ে রাখা অপরিহার্য। তাই প্রাকৃতিক এই রক্ষাকবচ সুন্দরবন সুরক্ষার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)