

শুক্রবার ● ১৭ জানুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » সংস্কৃতি ও বিনোদন » চিত্রনায়ক শেখ আবুল কাশেম মিঠুন
চিত্রনায়ক শেখ আবুল কাশেম মিঠুন
প্রকাশ ঘোষ বিধান
চিত্রনায়ক শেখ আবুল কাশেম মিঠুন। সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, গীতিকার, সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জল নক্ষত্র। আশির দশকের নায়ক মিঠুন। বাংলা চলচ্চিত্রের অসম্ভব গুণী একজন শক্তিমান অভিনেতা।
নিজ প্রতিভার গুণেই তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের বাংলা মিঠুন। সদালাপী মানুষ হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর ছিল ব্যাপক পরিচিতি। শুধু নায়ক বা অভিনেতা হিসেবেই নয়, তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির। এই সংগঠনের তিনি সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়ে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। পিতা মাতা প্রদত্ত নাম শেখ আবুল কাশেম। কিন্তু বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন মিঠু বলে। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করে মিঠু হয়ে যান নায়ক মিঠুন।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন ঘেঁষা আশাশুনি উপজেলার দরগাহপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ আবুল হোসেন ও মা হাফেজা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়। শেখ আবুল কাশেম মিঠুন সঙ্গীতা ও তরী নামের দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর পূর্ব পুরুষ শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদী ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদ থেকে আসেন। আশাশুনি উপজেলার দরগাহপুর এসে সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে তিনি এখানেই বসতি গড়ে তোলেন। দরগাহপুর গ্রামেই তাঁর দুই সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। উক্ত পুত্রদ্বয়ের বংশধরগণ দরগাহপুরের আদি অধিবাসী। শেখ মোহাম্মাদ শাহ বাগদাদী অন্যতম সপ্তম উত্তর পুরুষ মরহুম শেখ আব্দুল মতিন। শেখ আব্দুল মতিনের দৌহিত্র শেখ আবুল কাশেম মিঠুন। পারিবারিকভাবেই শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ছিলেন অভিজাত ইসলামী পরিবারের সন্তান।
১৯৭২ সালে জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলির আরকেবিকে এইচ.সি ১৯৭২ সালে জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলির আরকেবিকে এইচসি ইনস্টিটিউট হতে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি চলে আসেন খুলনায়। এখানে এসে তিনি ফুফাতো ভাই খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা শেখ আব্দুল জলিল এবং বংশের বড় বোন হাজেরা জলিলের বাসায় ওঠেন। এইচএসসিতে ভর্তি হন খুলনা সিটি কলেজে। এখান থেকে ১৯৭৪ সালে পাস করে একই কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করেন।
খুলনা সিটি কলেজে ভর্তি হয়েই দেয়াল পত্রিকা সঙ্গোপন -এর সম্পাদক হন। সাহিত্যে হাতেখড়ি তখন। বি এস সি তে ভর্তির পর তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতি অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে নূর মোহাম্মদ টেনা সম্পাদিত সাপ্তাহিক কালান্তর পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি কালান্তর এর কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কালান্তর ছেড়ে দিয়ে সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তারপর দৈনিক আবর্তন পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবেও কাজ করেন। আরো বড় সাংবাদিক হওয়ার আশায় একসময় তিনি খুলনা ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। রাজধানী ঢাকার আদাবরে পরিবারসহ ভাড়া থাকতেন মিঠুন।
শেখ আবুল কাসেম মিঠুন ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে যেমন নম্র, ভদ্র, তেমনি চেহারায়ও ছিলেন অনেকটা রাজপুত্রের মতো। যেমন স্বাস্থ্য তেমন উচ্চতা আর তেমনি ছিলো তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতা। ঢাকায় এসে শেখ আবুল কাসেম মিঠুন বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে এফডিসিতে সংবাদ সংগ্রহ করতে যান। সেই সময় তাঁর সুদর্শন চেহারা দেখে মুগ্ধ হন চিত্রপরিচালক হাফিজ উদ্দিন ও আলমগীর কুমকুম। তাঁদের আমন্ত্রণে শেষ পর্যন্ত অভিনয়ে প্রবেশ করেন শেখ আবুল কাসেম মিঠুন। শুরু হয় শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের অন্য এক বিচিত্র জীবনপ্রবাহ। সাংবাদিক থেকে নায়ক। ১৯৮০ সালে বজলুর রহমান পরিচালিত তরুলতা নামক চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। এরপর তিনি অভিনয় করেন বহু সুপারহিট চলচ্চিত্রে। ১৯৮২ সালে শেখ নজরুল ইসলাম পরিচালিত ঈদ মোবারক চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। পরে ভেজা চোখ, গৃহলক্ষ্মী, নরম-গরম, সারেন্ডার, নিঃস্বার্থ, বারা কেন চাকর, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, নিকাহ, গাড়িয়াল ভাই, রঙ্গিলা, ভাগ্যবতী, ধনবান, কুসুম কলি, অর্জন, ত্যাগ, বাদশাহ ভাই, জেলহাজত, ত্যাজ্যপুত্র ইত্যাদি। শুধু অভিনয় নয়, অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি গানও লিখতেন। একজন ভালো গীতিকার হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তরুলতা নামক চলচ্চিত্রে তিনি গীতিকার হিসেবে গান রচনা করেন। নায়ক ছাড়াও তিনি সিনেমার পার্শ্ব চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। এছাড়াও তিনি অসংখ্য সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন।
২০০০ সালে শেখ আবুল কাসেম মিঠুন সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন এবং আদর্শিক ধারায় কাজ শুরু করেন। তাঁর গল্প ও পরিচালনায় আহ্বান চলচ্চিত্র এবং তার চিত্রনাট্যে আল্লারাখা, ওরাও মানুষ নাটক ছাড়াও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মিত হয়েছে। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে তার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটিও ছিল বেশ জনপ্রিয়। অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাশেম মিঠুন আজীবন সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত স্ক্রিপ্ট রাইটার, পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিক-এর মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রর হাল ধরেন। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের উপ-পরিচালক। এক সময়কার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক মিঠুন ফিরে আসেন ইসলামী সংস্কৃতি ধারায়। এরপর তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে কাজ করে গেছেন।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ২০১৪ সালের মার্চে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন। তিনি যে কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন তার কথাবার্তায় তা কখনো ফুটে ওঠেনি। তিনি কিডনি, লিভার, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই ২০১৫ সালের ১১ মে তিনি তার অসুস্থ মা হাফেজা খাতুনকে দেখতে খুলনায় আসেন। অসুস্থ মাকে দেখতে এসে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শরীরের অবস্থার অবনতি হলে ১৪ মে বিকেলে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে ১৮ মে পর্যন্ত তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার আরো অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯ মে সকালে তাকে বেনাপোল সীমান্ত পথে ভারতের কোলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডা. পিবি শুকলা এবং কোটারী হাসপাতালের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ শামীমুল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোটারী হাসপাতালে ২৪ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৬ মে সন্ধ্যা ৭টায় পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে লাশ দেশে পৌঁছে। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সে রাত ১০টায় লাশ দরগাঁহপুর গ্রামে আনা হয়। রাত ১০ টার পর আবুল কাশেম মিঠুনের কফিন দরগাঁহপুর পৌঁছায়। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে জানাজা নামাজ দরগাহপুর এস কে আর এইচ কলেজিয়েট স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।
খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার ও নির্মাতা প্রয়াত শেখ আবুল কাসেম মিঠুনের প্রবন্ধ গ্রন্থ ইসলামে চলচ্চিত্র ও নাটক প্রকাশিত হয়েছে। চলচ্চিত্র ও নাটক বিষয়ক তার ৭টি প্রবন্ধ নিয়ে ইসলামে চলচ্চিত্র ও নাটক গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে। বইটি দেশজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছেন হাশেম আলী।৭৪ এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় তার রচিত উপন্যাসগ্রন্থ আমরাই ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তার দ্বিতীয় গ্রন্থ শিক্ষা ও সংস্কৃতির নেতৃত্ব: সংকট ও সংঘাত প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। তিনি আমৃত্যু চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি, মিডিয়াসহ বহুবিধ বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে গেছেন।
আবুল কাসেম মিঠুন ছিলেন অনন্য সাধারণ এক প্রতিভার অধিকারি। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবতাবাদী সংস্কৃতিসেবী। তিনি শুধু অভিনেতা, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও সংগঠক হিসেবেই বড় মাপের ছিলেন না, ব্যক্তি হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত উঁচুস্তরের। তার আজন্ম স্বপ্ন ছিল এদেশে আল্লাহপ্রদত্ত জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবতার মুক্তি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক সংস্কৃতিকর্মী।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট