শিরোনাম:
পাইকগাছা, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
সোমবার ● ৫ জুন ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বেদে সম্প্রদায়ের রহস্যময় জীবন ধারা
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বেদে সম্প্রদায়ের রহস্যময় জীবন ধারা
৫৩৪ বার পঠিত
সোমবার ● ৫ জুন ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বেদে সম্প্রদায়ের রহস্যময় জীবন ধারা

---

প্রকাশ ঘোঘ বিধান

বেদেরা বাঙালির অতি পরিচিত নৃ-গোষ্ঠী। সাধারণত ওরা ‘বাদিয়া’ বা ‘বাইদ্যা’ নামে পরিচিত । যাযাবর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেদে সম্প্রদায় অন্যতম। প্রান্তিক এই সম্প্রদায়ের সিংহভাগ নারী-পুরুষই ভাসমান জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তাদের একটা অংশ ডাঙায় স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও বড় অংশ নৌকায় নদীতে ভাসমান অবস্থায় বসবাস করে আসছে। স্থানীয়ভাবে এরা ‘বাইদ্যা’ নামে পরিচিত।

পৃথিবীব্যাপী রহস্যময় একদল মানুষ হলো জিপসি। এরা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে। দেশে দেশে বা অঞ্চলভেদে তাদের একেক নাম, আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্রসব পেশা। ১৪২৭ সালের দিকে প্যারিস নগরীতে হঠাত্ হাজির হয় একদল মানুষ। নর-নারী, শিশু—অদ্ভুত তাদের চেহারা, অদ্ভুত তাদের কথাবার্তা, উত্কণ্ঠিত প্যারিসকে তারা আশ্বস্ত করে লিটল ইজিপ্ট হিসেবে। পরে ইউরোপের নানা শহরে এদের দেখা যায়। পরিচয় দেয় লিটল ইজিপ্টের মানুষ হিসেবে। ইউরোপ তখন একবাক্যে মেনে নেয় এরা ইজিপ্টের মানুষ। ওদের পোশাক, ওদের ভাষা, ওদের চালচলন সব ইজিপশিয়ানদের মতোই বটে। এই ইজিপশিয়ান থেকে ক্রমেই এদের নাম হয়ে গেল জিপসি। আমাদের অঞ্চলের জিপসিরা বেদে নামেই পরিচিত, বেদে মানেও ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। নদীনির্ভর বাংলাদেশে বেদেদের বাহন তাই হয়ে ওঠে নৌকা। নৌকায় সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ-দেশান্তরে।

বেদেরা একটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের একটি অংশ। বেদেরা দাবি করে তারা মোগল আমলে ১৬৩৮ সালে আরাকান থেকে এ দেশে এসেছিলো।  কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজ বল্লাল রাজার সঙ্গে এরা ঢাকায় আসে। ঢাকা থেকে প্রথমে বিক্রমপুর অঞ্চল, পরে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এরা ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। বেশির ভাগ বেদেই হাতুড়ে চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়।  বেদে শব্দটির অবজ্ঞাসূচক ‘বাইদ্যা’ (হাতুড়ে ডাক্তার), পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ (চিকিৎসক) থেকে উৎপত্তি। কালক্রমে চিকিৎসা অর্থাৎ কবিরাজিতে সম্পৃক্ত হওয়ায় ‘বৈদ্য’ ‘বাইদ্যা’ থেকে ‘বেদে’ হয়ে যায়। এরা নৌকায় ঘুরে বেড়ায় গ্রাম থেকে গ্রামে, বন্দর থেকে বন্দরে। মাঝেমধ্যে স্থলে নোঙর ফেলে টোল বা তাঁবুতেও বাস করে।

বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এই ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা ভাষাভাষীর সাথে তারা বাংলা ভাষাও ব্যবহার করে। এই ঠেট ভাষার সাথে আরাকানদের ভাষার মিল আছে। তাদের ভাষায় ব্যবহৃত বেশির ভাগ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ  থেকে উদ্ভূত। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। যুদ্ধ ও শিকারে অতিশয় দক্ষ বেদেরা কষ্টসহিষ্ণু ও সাহসী। এদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতোই।

বেদেরা নিজেদের ‘মাঙতা’ বা ‘মানতা’ নামে ডাকে। মাঙতা অর্থ মেগে বা ভিক্ষা করে খাওয়া। তারা সাপ, বাঁদর, ভাল্লুক ইত্যাদি নাচিয়ে, শারীরিক কসরত- জাদুর খেলা দেখিয়ে, পোক-জোঁক ফেলে, শিঙ্গা বসিয়ে, শেকড়-বাকড় ও তাবিজ-কবজ বিক্রি করে, তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে- লোকজন থেকে যা পায়, তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে। তাই এরা নিজেদের মনতং বলে পরিচয় দিতে বেশি আগ্রহী।  বলে তারা নিজেদের ‘মানতা’ নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করে।

বেদেরা জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে অমর্যাদার কাজ বলে মনে করে। হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে ও নানা রকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়-বাকড় ভেষজ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে অর্থ রোজগার করে। তাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র অর্থাৎ ঝাড় ফুঁকের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। বেদেদের পেশার মধ্যে আছে ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ কবজ বিক্রি, সাপের কামড়ের চিকিৎসা করা, সাপের খেলা দেখানো, মাজা-কোমড়, হাত-পায়ের বাতের ব্যথা নিরাময়ের জন্য সিঙ্গা লাগানো, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, মৃত পশুর শরীরের অংশ ব্যবহার করে বা গাছপালা দ্বারা ওষুধ তৈরি করে বিক্রি করা, বানর খেলা দেখানো, জাদু দেখানো ইত্যাদি।

বেদেরা বেশ সাজগোজ করে। কোমরে বিছা আর গায়ে ইমিটেশন গহনা পরে। খোপায় ফুল গুঁজে রাখে মানুষকে আকর্ষণ করার জন্যই। সহজ-সরল জীবনযাপনকারী বেদেরা খুবই সৎ প্রকৃতির। অপরাধ করে গুরুতর শাস্তির ভয় থাকলেও সর্দারের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না। এদের জীবন ধারণের মান অত্যন্ত নিম্ন ও অপরিচ্ছন্ন। এদের খাদ্য তালিকায় বাছবিচার নেই। বিভিন্ন ধরনের মাদকেও এরা আসক্ত।

বেদে পুরুষরা লুঙ্গি পরে। মহিলারা দশহাত কাপড় দুই টুকরা করে এক টুকরা কোমরের নিচে দুপ্যাঁচ দিয়ে, অন্য টুকরা গলায় ওড়নার মতো ঝুলিয়ে রাখে এবং গায়ে পরে ফতুয়া অর্থাৎ আঙ্গি। বর্তমানে অনেক মনতং নারী ও পুরুষ বাঙালি নারী-পুরুষের মতেই পোশাক পরতে শুরু করেছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে যাযাবরের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ, যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ এবং হরজিন ১৫ লাখ। দেশে বেদের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। বেদেরা মোট ৯টি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হলো- লাউয়ো বা বাবাজিয়া, চাপাইল্যা, বাজিকর, বেজ বা মিচ্ছিগিরি, গাইন, ম্লেছ, বান্দাইরা, মাল ও সাপুড়িয়া। বিক্রমপুরের বিয়নিয়া, নারায়ণগঞ্জের চারার ঘোপ, কুমিল্লার আমিরাবাদ, মাইছাখালী, হুরাইল, নারগাঁও, নারায়ণপুর, হাজীগঞ্জ, লাকসাম ও মেহের কালীবাড়ি এলাকায় এদেরকে বেশি দেখা যায়।

গাইন বেদেরা সুগন্ধি মশলা বিক্রয় করে, এদের নিবাস নেত্রকোনায়। বেজ বেদেরা (মিচ্ছিগিরি) বরিশাল, পিরোজপুর ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে থাকে। এদের পেশা চোখের চিকিৎসা করা। এরা ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে চোখে অস্ত্রোপচার করে। চাপাইল্যা বেদেদের (সাজদার) পেশা হচ্ছে বিষ-ব্যথা নিরাময়কারী মাছের কাঁটা, বাঘের থাবা ও পাখির হাঁড়ের মালা বিক্রয় করা। এছাড়া এরা আফিম, মুক্তার অলঙ্কার, চুড়ি, শাঁখা, হাঁসুলি ও ঝিনুক বিক্রয় করে। এরা তাঁতী ও জোলাদের মতো সুন্দর সুন্দর সানা (বুনানি শলা) তৈরিতে পারদর্শী। এরা দক্ষ ডুবুরিও। এদের নিবাস ঢাকার টঙ্গী, ডেমরা ও বাড্ডা, মানিকগঞ্জের সাটুরিযা এবং কুমিল্লার আমিরাবাদে।

বাজিকর বেদেরা (মেল্লছ) শিয়ালের হাড় ও ধনেশ পাখির তেল বিক্রয় করে। শিয়াইল্যা বেদেরা সর্বভুক বলে অন্য বেদেদের সাথে তাদের লেনদেন হয় না। এরা গরু, শূকর, সাপ খায় এবং হিন্দু দেবদেবীর উপাসনা করে। এরা থাকে লালমনিরহাট ও ভারতের সীমান্ত এলাকায়। বান্দাইরা বেদে ওষুধ বিক্রয় করে ও বানরের খেলা দেখায়, বিভিন্ন ভোজবাজি ও শারীরিক কসরত উপস্থাপন করে। এরা রাম-লক্ষণ বন্দনা-গীত গায় এবং রাম-রাবণের শৌর্যবীর্য ও হনুমানের কীর্তির বর্ণনা করে। লালমনিরহাট ও ভারতের কলকাতায় এদের বসবাস।

মাল বেদেদের (মাল বৈদ্য) পেশা সাপের বিষ ঝাড়া, দাঁতের পোকা ফেলা, রসবাতের তেল বেচা এবং শিঙা ফুঁকা। এরা সাপ ধরে বিক্রয় করে কিন্তু সাপের খেলা দেখায় না। সাপুড়িয়া বেদেরা সাপের তাবিজ কবজ ও ওষুধ বিক্রয় করে এবং সাপ ধরে। এরা সাপের খেলা দেখায় কিন্তু সাপ বিক্রয় করে না। এরা মনসা দেবীকে এখনও খুব শ্রদ্ধা করে।

বেদে সম্প্রদায়ের জীবন ব্যবস্থা এবং তাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাস, নির্মিত হয়েছে নাটক-সিনেমা।  ১৯৩৯ সালে দেবকী বসু বেদে জনগোষ্ঠীর নিয়ে জীবন যাত্রা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যার নাম দেয়া হয় সাপুরে। এরপর লখিন্দর, নাগিন কন্যার কাহিনী, নাগিন , সর্প রানী, ‘সাপুড়ে মেয়ে’মহ অসংখ্য সিনেমা নির্মাণ হয়। বাংলাদেশে সাপের গল্প নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। বেদের মেয়ে জোছনা একটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র। ১৯৮৯ সালে মুক্তি লাভ করে। তবে সর্বশেষ বেদের মেয়ে জোসনা বাংলাদেশের লোকজ ধারার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ইলিয়াস কাঞ্চন ও অনজু ঘোষ অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি  এতদকালের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল ছবি।  বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে অন্যতম ব্যবসাসফল ছায়াছবি।

সাভারের রেডিও কলোনী পাশে বেদে পল্লী। মূলত অমরপুর, পোড়াবাড়ি, কাঞ্চনপুর ও বক্তারপুর এলাকা নিয়ে গঠিত এই বেদে পল্লী। এখানে প্রায় ১৫ হাজার বেদের বসবাস। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় নারী বেদেদের হাত পাততে দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগই থাকেন সাভারে। এই জনগোষ্ঠীর মেয়েরাই সংসারের চালিকাশক্তি। আর সন্তান লালন-পালন করে অলস সময় কাটান।  বছরের পর বছর এ চিত্র সাভারের বেদে পল্লীতে দেখা গেলেও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পেশা পাল্টাচ্ছে তারা।  বেদেরা মাতৃতান্ত্রিক হলেও বর্তমানে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সওদাগর শ্রেণী নাম দিয়ে তারা এখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্রময় ও সমস্যাসঙ্কুল হলো বেদে সম্প্রদায়ের জীবন।  বেদেদের সাবেক পেশায় আয় রোজগার কমে গেলে তাদের জীবনযাত্রায় নানামুখী পরির্বতন ঘটতে থাকে। কালের প্রভাবে এরা নিজেদের পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। এখন আর তারা আগের মতো সাপের খেলা, তাবিজ বেঁচে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না। কৃষি বা দিনমজুরি করে এখন এদেরকে জীবিকানির্বাহ করতে হচ্ছে।  অবশ্য কিছুসংখ্যক বেদে এখনও সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশায় যুক্ত। কিন্তু তার পরও দেশের একমাত্র যাযাবর শ্রেণিভুক্ত মানুষ বেদে সম্প্রদায় কষ্টের মধ্যে দিন পার করছে ।

বেদে আমাদের লোকসাহিত্যে অন্যতম উপজীবী। বেদে মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। নৌকাতেই ঘরবাড়ি, নৌকাতেই বসতি একদল রহস্যময় মানুষ। যাযাবরের মতো এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায় এরা।  আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্রসব পেশা। নদীনির্ভর বাংলাদেশে এখনও বেদেদের বাহন নৌকা। নৌকায়ই তাদের সংসার। এদের জীবন বৈচিত্রময়। তবে কালের প্রভাবে বেদের জীবন বৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন, আর এতে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)