শিরোনাম:
পাইকগাছা, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

SW News24
বুধবার ● ১৫ নভেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » সুন্দরবন » সুন্দরবনে ৪ শত বছরের পুরানো কালি মন্দির
প্রথম পাতা » সুন্দরবন » সুন্দরবনে ৪ শত বছরের পুরানো কালি মন্দির
১৮৫ বার পঠিত
বুধবার ● ১৫ নভেম্বর ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

সুন্দরবনে ৪ শত বছরের পুরানো কালি মন্দির

---

খুলনা শহর থেকে নদী পথে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে শিবসা নদীর পূর্বের পাড়ে রয়েছে শেখের খাল। তার কিছুটা দূরে এগিয়ে কালির খাল। এই দুই খালের মধ্যবর্তী স্থানটি শেখেরটেক নামে পরিচিত। এলাকাটি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে মধ্যযুগীয় স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ইটের দেয়াল ও ঢিবি। তবে দণ্ডায়মান স্থাপনা হিসেবে এখন শুধু টিকে আছে কালি মন্দির।

সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শেখেরটেক এ বাংলার মধ্যেযুগীয় ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালিমন্দির। আনুমানিক ৪০০ বছর ধরে ওই মন্দিরটি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও, এবার তা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে বন বিভাগ।

মোগল আমলে নির্মিত ওই মন্দিরটি ঘিরে তৈরি করা হয়েছে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। এটি সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কালাবগি ফরেস্ট স্টেশনের আদাচাই টহল ফাঁড়ির ১৬ নং কম্পার্টমেন্ট এলাকায় শিবসা নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত।

খুলনা শহর থেকে নদী পথে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে শিবসা নদীর পূর্বের পাড়ে রয়েছে শেখের খাল। তার কিছুটা দূরে এগিয়ে কালির খাল। এই দুই খালের মধ্যবর্তী স্থানটি শেখের টেক নামে পরিচিত। এলাকাটি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে মধ্যযুগীয় স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ইটের দেয়াল ও ঢিবি। তবে দণ্ডায়মান স্থাপনা হিসেবে এখন শুধু টিকে আছে কালিমন্দির!

বন বিভাগ শেখের টেক খাল থেকে মন্দির পর্যন্ত প্রায় সোয়া এক কিলোমিটার কংক্রিটের ফুট ট্রেলই নির্মাণ করছে। ওই ফুট ট্রেইলটি মন্দিরের চার পাশ থেকে ঘুরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের বনের উপরিভাগ দেখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। বনের মধ্যে কিছু স্থানে ইটের রাস্তাও তৈরী করা হয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে একটি টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে। সম্প্রতি ওই মন্দিরটি জরিপ করেছে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্দিরটি বর্তমানে খুবই ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় টিকে আছে। এর স্থাপত্যিক কাঠামো ও শিল্পশৈলীদৃষ্টে অনুমিত হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছে। এর দক্ষিণ ও পশ্চিমে দিকে রয়েছে দুটি প্রবেশদ্বার। এক গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ নিয়ে নির্মিত ওই মন্দিরটি। এতে মোট চার ধরনের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। যার পরিমাপ হলো, ২০*১৫*৪ সেমি, ২০*১৫*৪.৫ সেমি, ১৬*১২*৪ সেমি ও ১৬*১২*৫ সেমি।

মন্দিরের বাইরের অংশ ৬৫৫ সেন্টিমিটার বর্গাকার। আর ভেতরের অংশ ৩২৫ সেন্টিমিটার বর্গাকার। দেয়ালের পুরত্ব ১৬৫ সেন্টিমিটার। ভেতরে উত্তর দিকে একটি ছোট কুঠরি রয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশের প্রতিটি প্রবেশ পথ চওড়া ৯৭ সেন্টিমিটার। মন্দিরের বাইরের দিকে জ্যামিতিক নকশা, ফুল-লতা -পাতা প্রভৃতি সম্বলিত পোড়ামাটির অলংকৃত ইট ব্যবহার করা হয়েছে। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে প্রবলভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরটির অভ্যন্তরের বিভিন্ন স্থানেও ফাটল ধরেছে। মন্দিরটির শীর্ষে গাছপালা ও উদ্ভিদপূর্ণ। বড় বড় গাছের শিকড় প্রবেশ করে মন্দিরের ডোম ও দেয়ালগুলোকে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ইতোমধ্যে ডোম ও দেয়াল গুলোতে ফাটল ধরেছে। এই ফাটলের ফলে মন্দিরের ডোম ও দক্ষিণ পশ্চিম অংশ এবং উত্তর-পূর্ব কোনের অংশের ইট খসে পড়েছে। মন্দিরের চারপাশে দেয়াল হতে খসে পড়া ইটের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এছাড়াও মন্দিরের চারপাশে বিশেষ করে দক্ষিণ দিকে প্রচুর ছোট – বড় গাছ রয়েছে, যার ছায়ার কারণে মন্দিরে রৌদ্রের আলো প্রবেশ করতে পারে না।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, মন্দির তৈরিতে স্থানীয় শামুকের তৈরি চুন ও শিবসা নদীর বালু ব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

অনেক আগে সুন্দরবন ও এর আশপাশে যে মানুষের বসতি ছিল, ওই মন্দিরটি তার প্রমাণ বহন করে। মন্দিরটি আনুমানিক ৩০০-৩৫০ বছর আগে নির্মিত বলে এর স্থাপত্যিক কাঠামো ও শিল্পশৈলী দেখে অনুমান করা হচ্ছে। মন্দিরটি সংরক্ষণ করতে না পারলে অচিরেই তা ধ্বংস হয়ে যাবে। বন বিভাগের সহযোগিতা পেলে সেটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে সুন্দরবনের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরনো স্থাপনা হিসেবে শেখের টেক ও কালি মন্দিরকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে ওই স্থানটিতে কারা বসবাস করতো বা কী কারণে শেখেরটেক নাম হলো, তা কোনো ইতিহাস গ্রন্থে সঠিকভাবে তা বলা হয়নি।তবে বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের ইতিহাসে এই প্রত্নস্থানটি বারোভূঁইয়া বা মোগলদের (১৬০০ শতাব্দী বা সমসাময়িক) সময়কালের বলে মনে করা হয়। এই অঞ্চলের ইমারতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঢিবী শেখের বাড়ী নামে পরিচিত হলেও ইতিহাস মতান্তের শিবসা দুর্গ বলা হয়েছে।

১৯১৪ সালে প্রকাশিত সতিশ চন্দ্র মিত্রের লেখা যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খণ্ড বইতে শেখের টেকের কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ওই বইয়ে লেখা হয়েছে, সেখের খাল ও কালীর খালের মধ্যেবর্তী অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমি বিশিষ্ট নিবিড় জঙ্গলকে সেখের টেকে বলে। এখানে সুন্দরী গাছ যথেষ্ট, হরিণের সংখ্যা অত্যন্ত অধিক এবং ব্যাঘ্রাদি (বাঘ) হিংস্র জন্তুর আমদানিও বেশি। সুতরাং আমাদিগকে এক প্রকার প্রাণ হাতে করিয়া এ বনে ভ্রমণ করিতে হইয়াছিল। সেখের খালের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ডান দিকে চতুর্থ পাশখালির পার্শ্বে এক স্থলে ইষ্টক-গৃহের ভগ্নাবশেষ ও কয়েকটি গাবগাছ দেখা যায়। তথা হইতে উঠিয়া বনের মধ্যে প্রায় একমাইল গেলে, একটি দূর্গ দেখিতে পাওয়া যায়। সাধারণতঃ বাওয়ালীরা ইহাকে ‘বড় বাড়ী’ বলে।

সম্ভবতঃ ইহাই মহারাজ প্রতাপাদিত্যের শিবস দূর্গ। দূর্গের অনেক স্থানে উচ্চ প্রাচীর এখনও বর্তমান এই দূর্গের উত্তর-পূর্ব বা ঈশানকোণে একটি শিবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। সেখান হইতে দক্ষিণ-পূর্ব মুখে অগ্রসর হইলে, যেখানে সেখানে পুকুর ও পরে ৩টি ইষ্টকবাড়ী ও অসংখ্য বসতিভিট্টা পাওয়া যায়। বাড়িগুলির মাটির ঢিপি শত শত গাবগাছে ঢাকা রহিয়াছে। তাহা হইতে বাহির হইলে, একটু অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায একটি সুন্দর মন্দির দৃষ্টিপথবর্ত্তী হয়। সুন্দরবনের ভীষণ অরণ্যনীর মধ্যে বিবিধ কারুকার্য্য-খচিত এবং অভগ্ন অবস্থায় দণ্ডায়মান এমন মন্দির আর দেখি নাই।

বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, মন্দিরের অন্যান্য প্রকটি দেখিলে ইথা যে মোগল আমলে কোন হিন্দুকর্তৃক নির্মিত হইয়াছিল, তাহা অনুমান করা সহজ হয়। আরেক স্থানে লেখা হয়েছে, মন্দিরে কোন দেবদেবিগ্রহ নাই; তবুও অনুমান করা যায় যে, প্রতাপাদিত্য তাহার দৃর্গের সন্নিকটে এই কালিকা দেবীর মন্দির নির্মাণ করেন।

এছাড়া এ.এফ.এম. আব্দুল জলীলের সুন্দরবনের ইতিহাস নামক গ্রন্থেও ওই স্থাপনার বর্ণনা করা হয়েছে। তার বইয়ে লেখা হয়েছে, শেখের টেক অঞ্চলটির ক্ষেত্র গড়ে ১০ বর্গ মাইলে হবে। এককালে সেখানে বহুলোকের বসবাস ও গমনাগমন ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। সম্ভবত: মগ–পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচার হতে প্রজাগণকে রক্ষা করার জন্য মোগল শাসকেরা সেখানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেন এবং সুন্দর লোকালয় গড়ে তোলেন। মন্দিরটি হিন্দু রাজকর্মচারীদের জন্য নির্মিত হয়ে থাকবে।”তবে বইয়ের অন্য এক স্থানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “কেহ কেহ এই স্থানটিকে রাজা প্রতাপাদিত্যের শিবসা দুর্গ অথবা মোঘল নির্মিত কোন দুর্গ বলে অনুমান করেন।

 

 





আর্কাইভ